শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পদ্মা সেতু ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্নেল ফারুক আহমেদ, এএফডবিøউসি, পিএসসি

প্রকাশিত: ১০:৩৮ এএম, জুন ২৪, ২০২২

পদ্মা সেতু ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্নেল ফারুক আহমেদ, এএফডবিøউসি, পিএসসি

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য প্রমত্তা পদ্মার ওপর নির্মিত সুপ্রশান্ত পদ্মা সেতু আজ এক বাস্তবতা। ১৯৯৮-৯৯ সালে বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা নদীতে সেতু নির্মাণের প্রাক-সমীক্ষা সম্পন্ন করা হয়েছিল। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে সেতুর প্রাথমিক নকশা সম্পন্ন হওয়ার পর দেশবাসীর স্বপ্ন যখন কুঁড়ি হয়ে কেবল মেলতে শুরু করেছে,ঠক তখনই দেখা দেয় অর্থায়নের অনিশ্চয়তা। দেশের এই সংকটময় মুহূর্তে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের এক যুগান্তকারী ও বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ‘জনগণের সেনাবাহিনী’ দেশ ও জনগণের জন্য যে কোনো চ্যালেঞ্জিং কাজে সর্বদাই এগিয়ে এসেছে। পদ্মা সেতু নির্মাণেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। ২০১৩ সালের ২৫ জানুয়ারি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের বার্ষিক সম্মেলনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত খ্যাতিমান প্রকৌশলী ড.জামিলুর রেজা চৌধুরীর সঙ্গে আলোচনার সময় পদ্মা সেতু নির্মাণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে সম্পৃক্ত করার ব্যাপারে মত প্রকাশ করেন। পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের কাজ মোট পাঁচটি প্যাকেজের আওতায় পরিকল্পিত—মূল সেতু, নদীশাসন, দক্ষিণ প্রান্তে ১০ দশমিক ৫৭ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ রোড, উত্তর প্রান্তে ১ দশমিক ৬৭ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ রোড এবং প্রকল্পে নিয়োজিত পরামর্শক ও প্রকৌশলীগণের বাসস্হান (সার্ভিস এরিয়া-২)। মূল কাজ শুরুর ঠিক আগে পদ্মা সেতুর অ্যালাইনমেন্ট বরাবর নদীর ব্যাপক ভাঙন মোকাবিলায় এগিয়ে আসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। তিনটি প্যাকেজের (জাজিরা ও মাওয়া অ্যাপ্রোচ রোড এবং সার্ভিস এরিয়া-২) জন্য ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান আব্দুল মোনেম লিমিটেড-হাইওয়ে কনস্ট্রাকশন ম্যানেজমেন্ট এবং পরামর্শক হিসেবে কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কনসালটেন্ট, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে নিযুক্ত করা হয়। পরবর্তী সময়ে ডিসেম্বর ২০১৪ সালে মূল সেতু ও নদীশাসন কাজের জন্য যথাক্রমে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড ও সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেডকে নিয়োগ করা হয়। এভাবে সরকার বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ও বৃহদাকার মেগা প্রকল্পে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত করে। এর পাশাপাশি স্ট্র্যাটেজিক এই সেতুর সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে বাংলাদেশ সরকার ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৩ তারিখে ৯৯ কম্পোজিট ব্রিগেড নামে একটি নতুন ব্রিগেড গঠন করা, যার কার্যক্রম ১২ মার্চ ২০১৪ সাল থেকে শুরু হয়। এই লেখনীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কতৃর্ক পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের সম্পাদিত কাজগুলো তুলে ধরা হয়েছে। জাজিরা অ্যাপ্রোচ রোড: এই অ্যাপ্রোচ রোডে রয়েছে চার লেনবিশিষ্ট ১০ দশমিক ৫৭ কিলোমিটার দীর্ঘ মূল সড়ক, ২ লেনবিশিষ্ট ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ সার্ভিস সড়ক, পাঁচটি সেতু, আটটি আন্ডারপাস, ২০টি কালভার্ট, একটি সার্ভিস এরিয়া, টোল প্লাজা, থানা এবং ফায়ার স্টেশন বিল্ডিং। মাওয়া অ্যাপ্রোচ রোড: এই অ্যাপ্রোচ রোডে রয়েছে চার লেনবিশিষ্ট ১ দশমিক ৬৭ কিলোমিটার দীর্ঘ মূল সড়ক, ২ লেনবিশিষ্ট ১ দশমিক ৮৯ কিলোমিটার সার্ভিস সড়ক, একটি কালভার্ট, সার্ভিস এরিয়া, টোল প্লাজা, থানা এবং ফায়ার স্টেশন বিল্ডিং। অ্যাপ্রোচ রোডটি ২০১৪ সালে শুরু হয়ে ২০১৬ সালে শেষ হয়েছে। সার্ভিস এরিয়া-২: এই এরিয়ার মধ্যে নাগরিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত ৩০টি কটেজ, রিসিপশন বিল্ডিং, সুপারভিশন অফিস, সুইমিং পুল, টেনিস কমপ্লেক্স ও মোটেল মেস তৈরি করা হয়েছে। ২০১৪ সালে শুরু হয়ে ২০১৬ সালে এই প্যাকেজের কাজ শেষ হয়েছে। জাতীয় মহাসড়ক এন-৮: এ্যাক্সসওয়ে এন-৮ পদ্মা সেতুকে উত্তরে ঢাকা এবং দক্ষিণে ফরিদপুরের সঙ্গে যুক্ত করেছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি এন-৮ মহাসড়কটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের তত্বাবধানে নির্মিত হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই মহাসড়কের কাজ ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট উদ্বোধন করেন এবং ২০২০ সালের ১২ মার্চ এর কাজ সমাপ্ত হয়। মহাসড়কটি ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ,যার আওতায় রয়েছে পাঁচটি ফ্লাইওভার, দুটি ইন্টারচেঞ্জ, চারটি ওভারপাস, ২৯টি সেতু, ৫৪টি কালভার্ট এবং ১৯টি আন্ডারপাস। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর এন-৮ সড়ক ব্যবহার করে অতি স্বল্প সময়ে মানুষ ও মালামাল দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের ২১টি জেলা থেকে রাজধানী ঢাকায় পৌঁছাতে পারবে, যা ঐ অঞ্চলের আর্থসামাজিক উন্নয়নকে করবে ত্বরান্বিত। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প: সাশ্রয়ী মূল্যে বিপুল পরিমাণ যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের সুবিধার্থে পদ্মা সেতুর মূল নকশায় নিচের স্তরে ব্রডগেজ রেললাইনের ব্যবস্হা রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কনসালটেন্টের তত্বাবধানে এবং বাংলাদেশ রেলওয়ে কতৃর্পক্ষের ব্যবস্হাপনায় চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেডের মাধ্যমে এই প্রকল্পের নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে। প্রকল্পটি আর্থিক বিবেচনায় (৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা) বাংলাদেশ সরকারের সর্ববৃহৎ প্রকল্পগুলোর মধ্যে একটি। ১৪ অক্টোবর ২০১৮ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রকল্পটি উদ্বোধন করেন। এই রেল প্রকল্পের দৈর্ঘ্য ১৭২ কিলোমিটার এবং এর আওতাধীন রয়েছে ২৩ দশমিক ২৯ কিলোমিটার দীর্ঘ ভায়াডাক্ট বা উড়াল রেলসেতু, ৫৯টি বড় দৈর্ঘ্যরে সেতু, ১৪২টি কালভার্ট, ১৩৫টি আন্ডারপাস ও ২০টি স্টেশন। এ পর্যন্ত প্রকল্পের শতকরা ৬০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে।পদ্মা সেতুর নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৯৯ কম্পোজিট ব্রিগেডকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যাদের বলা হয় ‘চৎড়ঃবপঃড়ৎ ড়ভ চধফসধ ইৎরফমব’।পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পে নির্মাণ, নিরাপত্তা ও আনুষঙ্গিক কার্যক্রমে সরাসরি অংশগ্রহণের সুবর্ণ সুযোগ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে করেছে আত্মবিশ্বাসী এবং বাড়িয়েছে তার কর্মদক্ষতা। মহতি এ কাজে সম্পৃক্ত হয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জনগণের আস্হার প্রতীক হিসেবে নিজের অবস্হানকে করেছে সুদৃঢ়। লেখক: সাবেক সেনা কর্মকর্তা,সুত্র-ইওেফাক  
Link copied!