শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘পিঁপড়ার পেটে প্রণোদনা’

প্রকাশিত: ০৮:১২ এএম, জুন ১০, ২০২১

‘পিঁপড়ার পেটে প্রণোদনা’

জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সিনিয়র স্টাফ নার্স স্বপ্না (ছদ্মনাম)। বর্তমানে তার মূল বেতন ২৪ হাজার ৮৭০ টাকা। করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে দায়িত্ব পালনের সুবাদে দুই মাসের মূল বেতনের সমান ৪৯ হাজার ৭৪০ টাকা প্রণোদনা পাওয়ার কথা। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তার নামে বরাদ্দ দিয়েছে ৩৮ হাজার ৯২০ টাকা। এতে ন্যায্য পাওনা থেকেই তিনি বঞ্চিত হচ্ছেন ১০ হাজার ৮২০ টাকা। প্রণোদনার অর্থ বরাদ্দের তালিকা তৈরিতে মন্ত্রণালয়ের এমন ‘ভুলে’ তার মতো বঞ্চিত হচ্ছেন অনেকেই। মূল বেতনের চেয়ে কম অর্থ দেওয়ায় সরকারি সিদ্ধান্তের লঙ্ঘন হচ্ছে। এখানেই শেষ নয়, স্বপ্নার নামে বরাদ্দ দেওয়া ৩৮ হাজার ৯২০ টাকা থেকে ১১ শতাংশ হারে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার টাকা ভ্যাট কেটে রাখা হবে। প্রেষণের কর্মস্থলে গিয়ে এই সম্মানির অর্থ তুলতে যাতায়াতসহ সব মিলিয়ে ব্যয় হবে আরও অন্তত ১ হাজার টাকা। আধুনিক প্রযুক্তির এই যুগে কর্মঘণ্টা ও অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করে কর্মস্থলে গিয়ে হাতে হাতে প্রণোদনার অর্থ নেওয়াকে একধরনের হয়রানি হিসাবে দেখছেন ভুক্তভোগীরা। তারা বলেন, অনেককে হিসাবের চেয়ে কম টাকা দেওয়া হচ্ছে। এতে দায়িত্ব পালন করা নার্সদের সর্বশেষ মূল বেতনের সঙ্গে মিলিয়ে কাগজপত্র তৈরির সময় দেখা যাবে অনেক টাকা মন্ত্রণালয়ের হাতে রয়ে যাবে। সেই টাকার হিসাব মেলাবে কে? এ ধরনের অঙ্কের হিসাব না মেলায় স্বপ্নার মতো বঞ্চিতদের দীর্ঘশ্বাসই শুধু বাড়ে। এই বাড়তি পাওনা ঘিরে দেখা স্বপ্নগুলো রং হারায়। যোগ হয় হতাশা, নষ্ট হয়ে যায় কাজের স্পৃহা। এ পরিস্থিতিতে অনেক নার্সের বক্তব্য হচ্ছে-তবে কি ‘পিঁপড়ার পেটে যাচ্ছে তাদের প্রণোদনার অর্থ’। বঞ্চিতরা বলছেন, পেশাদারির কারণেই তারা দুর্যোগকালে জীবন বাজি রেখে করোনায় আক্রান্তদের চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন। চিকিৎসাসেবা পেয়ে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছাড়ার আগে রোগী ও স্বজনরা যে দোয়া করেছেন, সেটাই তাদের জন্য বড় পাওয়া। তারা কোনো প্রণোদনার আশায় কাজ করেননি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নিজে থেকেই প্রণোদনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। এখন তা কার্যকরে দায়িত্বহীন আচরণ করছেন সংশ্লিষ্টরা। জরুরি পরিস্থিতিতে একদিনের অর্ডারে তাদের কোভিট ডেডিকেটেড হাসপাতালে পোস্টিং দেওয়া হয়েছে। মাসের পর মাস তারা পরিবার-পরিজন ছেড়ে থেকেছেন। এমনকি ঈদের দিনও বাসার কারও সঙ্গে দেখা হয়নি। তখন কোনো কাগজপত্র লাগেনি। এখন প্রণোদনার অর্থ দেওয়ার নামে হয়রানির শেষ নেই। দফায় দফায় মন্ত্রণালয়ের চাহিদা মোতাবেক কাগজপত্র জমা দিতে হয়েছে তাদের। এরপরও অর্থ বরাদ্দের তালিকায় নয়ছয় করেছেন তারা। তেজগাঁওয়ের নাক, কান, গলা ইনস্টিটিউট থেকে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের আইসিউতে প্রেষণে তিন মাস কোভিড রোগীদের সেবা দিয়েছেন বেশ কয়েকজন সিনিয়র স্টাফ নার্স। তাদের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, চাকরিতে যোগদানের ৫ বছরের মাথায় তার যে মূল বেতন ছিল, সে হিসাবে তাকে প্রণোদনার অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এটা তুললে তিনি ১০ হাজার টাকার বেশি বঞ্চিত হবেন। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি জানান, প্রণোদনা না দিলেও তাদের কোনো দুঃখ ছিল না। এই প্রণোদনাকে তারা প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসাবে দেখছেন। তাই উপহার পাওয়ার ক্ষেত্রে এই অবহেলা মেনে নিতে পারছেন না। এ ব্যাপারে কথা বলতে নার্সিং অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সিদ্দিকা আক্তারের মোবাইল ফোনে সোম ও মঙ্গলবার একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি ধরেননি। তার হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলার সময় চাইলে তিনি সিন করলেও কোনো জবাব দেননি। ২৫ মে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯-এ আক্রান্তদের সেবায় নিয়োজিত ২৬৭৯ জন নার্সের ২ মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর মধ্যে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে সর্বোচ্চ সংখ্যক ৪৮৪ জন নার্স রয়েছেন। এ ছাড়াও কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল, কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল, শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, মিরপুরের মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান এবং ঢাকার বাইরে নারায়ণগঞ্জ, বগুড়া, নওগা, হবিগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকার মোট ২২টি প্রতিষ্ঠানের নার্সদের নামে বরাদ্দ দেওয়া অর্থের পরিমাণ ১১ কোটি ৫ লাখ ১২ হাজার ৩৫০ টাকা। এসব হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকদেরও প্রণোদনার অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অর্থ বরাদ্দ পাওয়ার কথা স্বীকার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বলেন, সরকারি আর্থিক নিয়মনীতি মেনেই এটা করা হয়েছে। উৎসে কর কর্তনের সরকারি নির্দেশনা আছে। তবে কেউ মূল বেতনের চেয়ে কম পেলে তার প্রতিষ্ঠান সেটি নিয়ে কথা বলতেই পারে। সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরাও তাদের মতামত জানাতে পারেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রণোদনা পাওয়া চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের তালিকা তৈরির আগে কয়েক দফা দরকারি কাগজপত্র জমা নেওয়া হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রেষণাদেশ, যোগদানপত্র, জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি, পিডিএস ফরম, মূল বেতনের সনদ। এসব কাগজপত্র জমা নেওয়ার পর কে কি পরিমাণ অর্থ পাবেন, তা নির্ধারণ করা হয়। এক্ষেত্রেই দায়িত্বহীনতার পরিচয় দেন সংশ্লিষ্টরা। তালিকায় অনেকের নামের পাশেই ৪/৫ বছর আগের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা হয়। এই তালিকা ধরে অর্থ বিতরণ করলে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা বঞ্চিত হবেন অনেকেই। রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে দায়িত্ব পালনকারী একজন নার্স নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তালিকায় তার নামে ৩২ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অথচ তার দুই মাসের মূল বেতন ৪২ হাজার টাকার বেশি। প্রায় একই পরিমাণ অর্থ কম পাচ্ছেন জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের দুজন নার্স। তারা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাদের মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগের পরামর্শ দেওয়া হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সাফ জানিয়ে দেয় এ ভুল মন্ত্রণালয়ের। এছাড়াও জাতীয় নাক, কান, গলা ইনস্টিটিউটের ১ জন, হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের ১ জন এবং কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের ১ জন নার্সের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তালিকা অনুযায়ী অর্থ গ্রহণ করলে তারাও ন্যায্য পাওনা থেকে ১০-১২ হাজার টাকা করে বঞ্চিত হবেন। সিলেটে দায়িত্বরত একজন চিকিৎসক জানান, মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কোনো আর্থিক লাভ না থাকায় দায়সারাভাবে তারা এ কাজগুলো করছেন। ফলে তালিকায় ভুল হয়েছে। অথচ জীবনবাজি রেখে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা করোনায় আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিয়েছেন। সেবা দিতে গিয়ে অনেকেই মারা গেছেন। তাই ফ্রন্টলাইনারদের প্রণোদনার তালিকায় এমন ভুলভ্রান্তি মোটেই কাম্য নয়। এ ব্যাপারে কথা বলতে স্বাস্থ্য সচিব লোকমান হোসেন মিয়ার মোবাইল ফোনে মঙ্গলবার দুপুরে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। এর আগে সোমবার সন্ধ্যায় তার হোয়াটসঅ্যাপে প্রশ্ন পাঠালেও তিনি কোনো জবাব দেননি। প্রসঙ্গত, গত বছরের ৮ মে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রথম ঢেউ বাংলাদেশে আছড়ে পড়লে চরম ভীতি ছড়িয়ে পড়ে সব মহলে। মৃত্যুভয়ে নিজেকে নিরাপদ রাখতে মা-বাবার মৃতদেহের কাছে যায়নি ছেলে-মেয়েরা। যখন চারদিকে হাহাকার, তখন আক্রান্তদের পাশে থেকেই চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। তাদের কাজে আগ্রহ বাড়াতে প্রণোদনা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
Link copied!