শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পুলিশে চাকরি ১৯৯৭ সালে পদোন্নতি ১৯৯১-এ

প্রকাশিত: ১১:০১ এএম, অক্টোবর ১১, ২০২১

পুলিশে চাকরি ১৯৯৭ সালে পদোন্নতি ১৯৯১-এ

জ্যেষ্ঠতার সাধারণ নীতিমালা না মেনে ৩৬ জন কর্মকর্তাকে (পুলিশ পরিদর্শক) পদোন্নতির প্রস্তাবে পুলিশ প্রশাসনে ক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। ১৯৯১ সালে এসআই হিসাবে নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন অবস্থায় বাতিল হওয়ার ছয় বছর পর ১৯৯৭ সালে নির্বাহী আদেশে তারা (বর্তমানে পুলিশ পরিদর্শক) চাকরি পান। তাদেরসহ ১০০ জন পুলিশ পরিদর্শকের পদোন্নতির (এএসপি) বিষয়ে ৮ আগস্ট পুলিশ সদর দপ্তর থেকে সংশ্লিষ্ট ইউনিটপ্রধানদের কাছে ক্লিয়ারেন্স চাওয়া হয়। অথচ ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সালে বিভিন্ন ব্যাচের প্রায় ৭০০ কর্মকর্তার নাম ওই তালিকায় নেই। জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে ক্লিয়ারেন্স (তালিকা) চাওয়ায় কর্মরত পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে। জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে এ পদোন্নতির প্রস্তাবে ক্ষুব্ধ স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) এক পুলিশ কর্মকর্তা ১৫ সেপ্টেম্বর আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদের কাছে চিঠি দিয়েছেন। ১৯৯২ সালে সরাসরি এসআই পদে যোগদানকারী কর্মকর্তাদের পক্ষে তার লেখা চিঠিতে বলা হয়-‘পদোন্নতির তালিকায় ১৯৯৭ ব্যাচের ৩৬ জন কর্মকর্তার নাম রয়েছে। অথচ ওই তালিকায় ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সালে বিভিন্ন ব্যাচে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রায় ৭০০ কর্মকর্তার নাম নেই। কয়েক বছরের জুনিয়র যে কর্মকর্তাদের পদোন্নতির জন্য বিবেচনা করা হচ্ছে-তারা আমাদের অধীনে পিএসআই হিসাবে কর্মরত ছিলেন। তারা এখন এএসপি হলে তাদের জুনিয়র হয়ে আমাদের চাকরি করতে হবে। তখন আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হবে এবং হীনম্মন্যতায় ভোগা ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। নিজের পরিবারের কাছেও মনের দিক থেকে ছোট হয়ে থাকতে হবে। বিষয়টি আমাদের জন্য এ শেষ বয়সে অনেক পীড়াদায়ক। তাই তালিকা থেকে ১৯৯৭ ব্যাচের সদস্যদের বাদ দিয়ে নিয়ম অনুসারে পদোন্নতির ব্যবস্থা করা হোক। অন্যথায় আমরা চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর নিতে বাধ্য হব।’ চিঠিটির একটি কপি যুগান্তরের হাতে এসেছে। এ চিঠির সূত্র ধরে অনুসন্ধানে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৯৭ সালে এসআই হিসাবে যোগদানকারী ১৭১ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে ২০০৯ সালের এক আদেশ অনুযায়ী তাদের ১৯৯১ সাল থেকে সিনিয়রিটি দেওয়া হয়েছে। অথচ তাদের আগে সিনিয়রিটি পাওয়ার কথা ছিল ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সরাসরি এসআই (বতর্মানে পরিদর্শক) হিসাবে যোগ দেওয়া এবং বিভাগীয় পদোন্নতিপ্রাপ্ত আড়াই হাজার কর্মকর্তার। কিন্তু তাদের সবাইকে বাদ দিয়ে কয়েক বছর পর যোগদানকারী কর্মকর্তাদের সিনিয়রিটি দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি এএসপি পদে পদোন্নতির জন্য ১০০ জনের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এ তালিকায় ১৯৯৭ সালের ব্যাচের ৩৬ জনের নাম রয়েছে। এ ক্ষেত্রেও বঞ্চনার শিকার দুই হাজারের বেশি কর্মকর্তা। বিষয়টি নিয়ে পুলিশ প্রশাসনে ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে। আইজিপিকে দেওয়া চিঠিতে বঞ্চিতরা উল্লেখ করেছেন-পদোন্নতির জন্য বিবেচিত তালিকা থেকে জুনিয়রদের বাদ দেওয়া না হলে পুলিশ বিভাগে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব বাড়বে। ভেঙে পড়তে পারে চেইন অব কমান্ড। বেআইনি আদেশের কারণে বর্তমান সরকার ভবিষ্যতে প্রশ্নবিদ্ধ হবে। প্রচলিত আইন ও বিধিভঙ্গের কলঙ্কময় নজির সৃষ্টি হবে। অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৯০ সালে সরাসরি সাব-ইন্সপেক্টর (এসআই) পদে ২৮৭ জনের নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু অনিয়মের অভিযোগে ১৯৯১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ওই নিয়োগ বাতিল করে দেয়। এরপর ১৯৯৭ সালে এক নির্বাহী আদেশে তাদের মধ্য থেকে ১৭১ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এক বছরের মৌলিক প্রশিক্ষণ গ্রহণসহ আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া শেষে ১৯৯৮ সালের নভেম্বরে তারা শিক্ষানবিশ এসআই হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। দুই বছর শিক্ষানবিশ এসআই হিসাবে বাস্তব প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর ২০০০ সালের শেষের দিকে এসআই হিসাবে তাদের চাকরি স্থায়ী হয়। নিয়ম অনুযায়ী ২০০০ সাল থেকে তাদের সিনিয়রিটি গণ্য হওয়ার কথা। কিন্তু ১৯৯১ সাল থেকে তাদের সিনিয়রিটি দেওয়ার জন্য ২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন সংস্থাপন ও প্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম একটি নির্বাহী আদেশ জারি করেন। এ ক্ষেত্রে পুলিশ বিভাগের অভ্যন্তরীণ নীতিমালা ও পুলিশ প্রবিধানের (পিআরবি) নিয়মনীতি অগ্রাহ্য করা হয়। ওই নির্বাহী আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বিভাগীয় নিয়মনীতি উপেক্ষা করে ২০১২ সালে পরবর্তী পদোন্নতির জন্য তালিকায় তাদের নাম আগে দেওয়া হয়। এতে ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত ৭৫০ এসআই এবং বিভাগীয় পদোন্নতিপ্রাপ্তসহ প্রায় ১৫০০ পরিদর্শক বঞ্চিত হন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি আমিনুল ইসলাম বলেন, নিয়ম অনুযায়ী চাকরি স্থায়ী হওয়ার পর থেকে সিনিয়রিটি গণ্য হয়। ১৭১ কর্মকর্তার সিনিয়রিটির বিষয়টি কীভাবে গণ্য করা হয়েছে তা আমার জানা নেই। বিষয়টি নিয়ে রিক্রুটমেন্ট শাখার কর্মকর্তারা ভালো বলতে পারবেন। এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের রিক্রুটমেন্ট শাখার এআইজি মাহফুজুর রহমান আল মামুনের সঙ্গে একাধিকবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কোনো সাড়া দেননি। হোয়াটস অ্যাপে তাকে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হলে তিনি তা ‘সিন’ করেন। তবে কোনো মন্তব্য করেননি। ‘বঞ্চিত’ পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন এবং বাংলাদেশ পুলিশ প্রবিধান (পিআরবি) অনুসারে পুলিশ বিভাগে পদোন্নতিসহ সব কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ১৭১ জনের পদোন্নতির নির্বাহী আদেশ পুলিশ বিভাগের অভ্যন্তরীণ নীতিমালার সম্পূর্ণ পরিপন্থি। এটি অজ্ঞতাবশত, অবাস্তব ও বিভাগীয় নিয়মনীতির পরিপন্থি। তাই আদেশটি বাতিলযোগ্য এবং কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক ও তেজগাঁও থানার ওসি অপূর্ব হাসান বলেন, দুই পক্ষের বক্তব্যেরই যুক্তি আছে। ১৯৯৭ সালে যাদের চাকরি হয়েছে ১৯৯১ সালে তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়। ওই সময় প্রক্রিয়া বাতিল না হলে তারা তখনই চাকরিতে যোগ দিতেন। এ ক্ষেত্রে ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সালে যোগদানকারীদের চেয়ে তারা সিনিয়র থাকতেন। আবার পুলিশ প্রবিধান অনুযায়ী চাকরি স্থায়ী হওয়ার আগে কেউ সিনিয়রিটি পাওয়ার যোগ্য হতে পারে না। এ ক্ষেত্রে ২০০০ সাল থেকে তারা সিনিয়রিটি পাওয়ার যোগ্য। তিনি আরও বলেন, যে প্রক্রিয়ায় তাদের নিয়োগ বাতিল হয়েছিল আবার সে প্রক্রিয়াতেই তারা (১৯৯১-১৯৯৭ ব্যাচ) চাকরিতে পুনর্বহাল হয়েছেন। এখন যারা নিজেদের বঞ্চিত বলে মনে করছেন-তারা এ প্রক্রিয়ায় (রাজনৈতিক) সফল হতে পারলে হোক। তাদের চাকরি ছেড়ে দেওয়ারও অধিকার আছে।
Link copied!