শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিআরটি এখন গলার কাঁটা

প্রকাশিত: ১২:৪১ পিএম, আগস্ট ১৮, ২০২২

বিআরটি এখন গলার কাঁটা

বিমানবন্দর থেকে গাজীপুরের জয়দেবপুর পর্যন্ত অংশ বাস্তবায়নের পাশাপাশি কেরানীগঞ্জ থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত আরেকটি বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প হওয়ার কথা ছিল। এজন্য ৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে বিস্তারিত সমীক্ষা এবং নকশাও প্রণয়ন করা হয়েছিল। কিন্তু গাজীপুর-বিমানবন্দর অংশের ৫ বছরের প্রকল্প ১১ বছরেও শেষ করতে না পারায় খরচ প্রায় সোয়া ২ হাজার কোটি টাকা বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে জনদুর্ভোগ। এসব কারণে কেরানীগঞ্জ থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত বিআরটি রুট করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে সরকার। পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, খণ্ডিত বিআরটি প্রকল্প থেকে কাক্সিক্ষত সুফল মিলবে না। ত্রুটিপূর্ণ সমীক্ষা, চায়না ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সঙ্কট, বারবার নকশা পরিবর্তন, ঢাকা বিআরটি কোম্পানির অদক্ষতার কারণে এ প্রকল্প কার্যত সরকারের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত সড়কে বিআরটি-৩ প্রকল্প গ্রহণ করা হয় ২০১২ সালে। সাড়ে ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা ঢাকা বিআরটি কোম্পানি লিমিটেড। ২০১৬ সালে প্রকল্প শেষ করার কথা থাকলেও প্রায় ১১ বছরেও তা শেষ হয়নি। বর্তমানে প্রায় ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। পুরো প্রকল্প শেষ করতে আরও কমপক্ষে এক বছর লাগবে বলে জানা গেছে। শুরুতে প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। বারবার সময় বাড়ানোর কারণে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা। প্রকল্পটিতে অর্থায়ন করছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ফরাসি উন্নয়ন সংস্থা এএফডি, গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি নামে একটি সংস্থা ও বাংলাদেশ সরকার। কর্মকর্তারা জানান, বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট সিস্টেম একটি বাসভিত্তিক গণপরিবহন ব্যবস্থা যেখানে উন্নত মানের বাসগুলো সাধারণত ডেডিকেটেড লেনে দ্রুত ও নিরাপদে চলাচল করে যাত্রী পরিবহন করে থাকে। এ পদ্ধতিতে স্টেশনে ঢোকার পূর্বেই যাত্রীদের টিকেট সংগ্রহ করতে হয় এবং ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে ভাড়া আদায় করা হয়ে থাকে। ওঠা-নামার জন্য বাসে চওড়া দরজার ব্যবস্থা থাকে এবং বাসগুলো স্টেশন প্লাটফর্মের সমতলে থামিয়ে যাত্রীদের দ্রুত আরোহণ ও অবরোহণের ব্যবস্থা করে দেয়। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গাজীপুর-বিমানবন্দর অংশে বিআরটি নির্মাণে ২০১১ সালে প্রাথমিক সমীক্ষা করে এডিবি। তবে পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা ও নকশা হওয়ার আগেই প্রকল্প নেওয়া হয়। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে নানা সমস্যা তৈরি হয়। এ ছাড়া বিআরটি প্রকল্পে প্রথমে উড়ালসড়কের পথ বক্স গার্ডার ধরে নকশা করা হয়। কিন্তু নির্মাণকাজ শুরুর দুই বছর পর ঠিকাদারের চাপে তা পরিবর্তন করে ‘আই’ গার্ডার করা হয়। কারণ হিসেবে বলা হয়, বক্স গার্ডার হলে পর্যাপ্ত জায়গা পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমন বলেন, প্রথমে প্রকল্পটি গাজীপুর থেকে এয়ারপোর্ট হয়ে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত নেওয়ার কথা থাকলেও সেটা করা হচ্ছে না। এ কারণে এ প্রকল্প থেকে কাক্সিক্ষত সুফল মিলবে না। যাত্রীরা বিমানবন্দরে নামার পর তারা রাজধানীর ফার্মগেট বা মতিঝিল এলাকায় আসবেন কী করে। সে দুর্ভোগ তো থেকেই যাবে। বিআইপি সভাপতি বলেন, আমাদের দেশের সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রণয়নে ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে যাচ্ছে। এটা প্রণয়নের সময় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মতামত নেওয়া উচিত। কিন্তু সেটা করা হচ্ছে না। এজন্য প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে নানাবিধ জটিলতা হচ্ছে। তিনি বলেন, যানজট নিরসনের উদ্দেশ্যে এ প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও এটা এখন যানজট ও জনদুর্ভোগের বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকল্পের অর্ধেক অংশ শেষ করতেই দশ বছরের বেশি সময় লাগছে। এতে ব্যয় বেড়েছে। এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এজন্য প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি এবং সরকারের যারা তদারকির দায়িত্বে ছিলেন তারা কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারেন না। বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক, বিশিষ্ট পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, যানজট এড়িয়ে গণপরিবহনে চলার ভালো উপায় হলো বিআরটি। তবে ব্যস্ততম শিল্প এলাকা গাজীপুরের এ করিডোরটি বিআরটির জন্য প্রযোজ্য ছিল না। বিআরটির জন্য যেভাবে ওভারপাসগুলো করা হয়েছে তাতে নিচের রাস্তায় অনেক ভোগাবে। তিনি বলেন, ঢাকায় একের পর এক অপরিকল্পিত ফ্লাইওভার নির্মাণ করে বিআরটির জায়গা নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। জয়দেবপুর থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত খণ্ডিত বিআরটি কতটা সুফল দেবে, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। তিনি বলেন, স্বাভাবিক ব্যবস্থায় একটা বাস সড়কে যত যাত্রী পরিবহন করতে পারে, বিআরটিতে তার ১০ গুণ বেশি হয়। কিন্তু পথ পরিবর্তন এবং এর মধ্যে উড়ালসড়ক, পাতালপথ যুক্ত করার কারণে বিআরটি প্রকল্পটি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, পৃথিবীর ১৮০টি দেশে বিআরটি প্রকল্প রয়েছে। কোথাও আমাদের মতো এত বেশি সময় লেগেছে- এমন উদাহরণ নেই। শুধু দেশে নয়, সারা বিশ্বের বিআরটি প্রকল্পের মধ্যে এটি বড় নেতিবাচক দৃষ্টান্ত। বিআরটি প্রকল্প ব্যর্থতার বড় এক উদাহরণ তৈরি করেছে। তবে ঢাকা বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ঢাকা বিআরটি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সফিকুল ইসলাম বলেন, বিআরটি বাসের জন্য ডেডিকেটেড লেনের ব্যবস্থা এবং সড়ক প্রশস্তকরণের ফলে বিআরটি বাসগুলো করিডোরের অন্যান্য যান চলাচলে বাধা সৃষ্টি করবে না। এ ছাড়া ফ্লাইওভার এবং গুরুত্বপূর্ণ ইন্টারসেকশনসমূহে মিক্সড ট্রাফিক লেনের গাড়িগুলোর জন্য ইউটার্ন এবং ডান ও বাম দিকে যাওয়ার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকবে। প্রকল্পের মেয়াদ বারবার বৃদ্ধির পাশাপাশি খরচ বৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রকল্পের সব কাজ সঠিকভাবে যথাসময়ে সম্পন্ন করা সবসময় হয় না। ভূমি অধিগ্রহণ ও বিদ্যমান সড়কের অপ্রতুল ড্রেনেজ ব্যবস্থা এবং নির্মাণকাজে নিয়োজিত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের অপর্যাপ্ত অর্থপ্রবাহের কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হয়েছে। এ ছাড়া কোভিড মহামারির কারণেও প্রকল্পের অগ্রগতি বিঘ্নিত হচ্ছে। তিনি বলেন, খরচ বেশি হয়েছে এটা সঠিক নয়। কারণ একেক দেশের খরচ একেক রকম হবে এটাই স্বাভাবিক। আর আমাদের এখানে শুধু বিআরটির কাজ হচ্ছে না, প্রকল্পের সঙ্গে ফুটপাথ, ব্রিজ ও রাস্তাও নির্মাণ করা হচ্ছে। তাই অন্য দেশের খরচের সঙ্গে ঢাকা বিআরটির খরচ মেলানো ঠিক হবে না। তিনি জানান, এয়ারপোর্ট পর্যন্ত প্রকল্প শেষ হওয়ার পর বিআরটি আর কতদূর পর্যন্ত যাবে সে বিষয়টি নিয়েও চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। সফিকুল ইসলামের জানান, আগামী বছর বিআরটি-৩ চালু করা সম্ভব হবে। সর্বশেষ বর্ধিত সময়সীমা গত জুনে অনুমোদন পেয়েছে এবং প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা। ঢাকা বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের পরিচালনা পর্যদের সদস্য এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্ল্যাহ বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে অনেক সুবিধা হবে। যেমন জয়দেবপুর থেকে মাত্র কয়েক মিনিটে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত পৌঁছানো যাবে। কোনো যানজটে পড়তে হবে না। এতে সময় অনেক বাঁচবে, জনগণ উপকৃত হবে। তবে প্রকল্পের মেয়াদ বারবার বৃদ্ধির কারণে খরচ অনেক বেড়ে গেছে। বিষয়টি নিয়ে পরিচালনা পর্যদে বিভিন্ন সময় আলোচনা হয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দ্রুত প্রকল্প শেষ করতে বারবার বলা হয়েছে। এখন প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে, সময় আর বেশি লাগবে না চালু করতে। বিআরটি প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানান, এ প্রকল্প চালু হওয়ার পর প্রতিদিন প্রায় ১৩০টি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বৈদ্যুতিক বাস ঢাকা-গাজীপুর রুটে ৪ হাজার যাত্রী পরিবহন করবে। গাজীপুর থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত ২০ দশমিক ৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে দেড় থেকে তিন ঘণ্টা লেগে যায়। তবে বিআরটি চালু হলে মাত্র ৩৫-৪০ মিনিটে যাতায়াত করা যাবে। বিআরটির যাত্রীরা দিয়াবাড়ীর উত্তরা স্টেশন থেকে মেট্রোরেল পেতে একটি ডেডিকেটেড বাস পাবেন। ডেডিকেটেড লেন ব্যবহারের কারণে বিআরটি বাসগুলো ২-৫ মিনিটের ব্যবধানে ২৫টি স্টেশন থেকে যাত্রী পরিবহন করবে। যাত্রীদের সুবিধার জন্য স্টেশনগুলোতে ই-টিকেট সিস্টেম, স্বয়ংক্রিয় টিকেট কাউন্টার এবং একটি ইন্টেলিজেন্ট ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম থাকবে। কর্মকর্তারা জানান, যাত্রীদের গতিশীলতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পৃথিবীর বহু দেশে সফলতার সঙ্গে বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট সিস্টেম প্রবর্তন করা হয়েছে। ১৯৭৩ সালে কানাডার অটোয়াতে ‘ট্রানসিটওয়ে’ নামে বিশ্বের প্রথম বিআরটি চালু হয়। বর্তমানে কলম্বিয়া, চীন, ভারত, পাকিস্তান, ফ্রান্সসহ বিশ্বের ১৮০ দেশে বিআরটি চালু আছে। ছয় মহাদেশজুড়ে ১৬৬টি শহরে ৪৯০৬ কিলোমিটার লেনসমেত বিআরটি সিস্টেম বাস্তবায়িত হয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে প্রতিদিন প্রায় ৩ কোটি ২২ লাখ যাত্রী যাতায়াত করছে। লাতিন আমেরিকায় সর্বাধিক ৫৪টি শহরে বিআরটি সিস্টেম রয়েছে, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে ব্রাজিলে ২১টি। লাতিন আমেরিকায় বিআরটিতে সর্বাধিক দৈনিক যাত্রীবহনকারী দেশগুলো হচ্ছে ব্রাজিল (১ কোটি ৭ লাখ), কলম্বিয়া (৩০ লাখ ৬০ হাজার) এবং মেক্সিকো (২৫ লাখ)। অন্যান্য অঞ্চলের মধ্যে চীন (৪৩ লাখ) এবং ইরান (২১ লাখ) প্রণিধানযোগ্য। বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা সংযোগকারী ২৫১ দশমিক ২ কিলোমিটার দীর্ঘ ‘ট্রান্সজাকার্তা’কে বিশ্বের বৃহত্তম বিআরটি নেটওয়ার্ক হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
Link copied!