মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১

দুর্নীতিবাজ তিন শতাধিক প্রভাবশালীকে টার্গেট দুদকের

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৮, ২০২৪, ১০:১৭ এএম

দুর্নীতিবাজ তিন শতাধিক প্রভাবশালীকে টার্গেট দুদকের

দেশে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে অনেকটা নীরব ছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে সরকারের পালাবদলে রাতারাতি পাল্টে যায় সংস্থাটির কার্যক্রম। গত মাস থেকেই একের পর এক প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে যারা গত ১৬ বছরে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন,তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে সংবিধিবদ্ধ সংস্থাটি।
বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী-এমপি, ব্যবসায়ী, আমলা ও পুলিশ কর্মকর্তাসহ তিন শতাধিক ব্যক্তিকে টার্গেট করে এগোচ্ছে দুদক। এর মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে অর্ধশতাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। এ তালিকায় সাবেক মন্ত্রী-এমপি, সাবেক সেনাপ্রধান ও সাবেক কয়েকজন পুলিশপ্রধানও রয়েছেন।
দুদক সূত্রে জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের তিন শতাধিক ব্যক্তির তালিকা ধরে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান কার্যক্রমে কমিশনের শতাধিক কর্মকর্তাকে যুক্ত করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। সংস্থাটির গোয়েন্দা ইউনিটের তৎপরতা বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যক্তিপর্যায় থেকে অভিযোগ নেয়া ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত দুর্নীতিসংক্রান্ত প্রতিবেদনগুলো যাচাই-বাছাই করে তাৎক্ষণিকভাবে কমিশন থেকে অনুসন্ধানের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে।
ইতোমধ্যে অর্ধশতাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে শুরু হওয়া অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে কমিশনের দুই ডজন কর্মকর্তাকে। কর্মকর্তারা অভিযোগের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গত এক সপ্তাহে ২০ জনকে তলব করলেও তারা কেউই দুদকে হাজির হননি।
এমনকি সময় চেয়েও আবেদন করেননি বলে জানা গেছে। অনেকের বিরুদ্ধে আদালতের মাধ্যমে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞাও দেয়া হয়েছে। যারা দুদকের ডাকে সাড়া দেননি, তাদের গ্রেপ্তারে সংস্থাটির গোয়েন্দা ইউনিটের কর্মকর্তারা এসব ব্যক্তিদের অবস্থান নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করছেন এবং গ্রেপ্তারে তৎপর রয়েছেন বলেও জানা যায়।
দুদকের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আলোচনায় থাকা এসব ব্যক্তি হয় দেশ ছেড়েছেন, নয়তো আত্মগোপন করে আছেন। তবে তাদের শনাক্তে আমাদের গোয়েন্দা ইউনিটের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের প্রভাবশালী এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ, ব্যাংক ও শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, অর্থ পাচার, নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, কমিশন বাণিজ্য, সরকারি-বেসরকারি জমি-সম্পত্তি দখল, লুটপাটসহ নানা অনৈতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ১৫ আগস্ট সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জন ও পাচারের অভিযোগ প্রথম অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। এরপর এ তালিকায় যুক্ত হয়েছেন সাবেক সরকারের অর্ধশতাধিক ক্ষমতাবান ব্যক্তি।
দুদকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একটি বড় অংশ এখন বিগত সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দুর্নীতি ও অনিয়মসংক্রান্ত অভিযোগ নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। অনুসন্ধানসংশ্লিষ্ট দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, যাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে- তাদের অনেকের সম্পদের তথ্য চেয়ে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), নিবন্ধন অধিদপ্তর, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ, যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
এসব তথ্য পাওয়া গেলে তা যাচাই-বাছাই শেষে সম্পদ জব্দের জন্য আদালতে আবেদন করা হবে। অনুসন্ধান কর্মকর্তারা এ বিষয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এছাড়া অনুসন্ধানের আওতায় থাকা প্রত্যেককে তাদের সম্পদ বিবরণী দাখিলের জন্য নোটিস পাঠানো হবে।
অনুসন্ধানের বিষয়ে সম্প্রতি দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন সাংবাদিকদের বলেছেন, অভিযোগ আসা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দুদকের গোয়েন্দা ইউনিটের তথ্যে প্রাথমিক সত্যতা থাকায় কমিশন তাদের দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
যাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে তারা হলেন সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী (জাভেদ), নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, ও খালিদ মাহমুদ চৌধ:ুরী, গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, সাবেক পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়কমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের শ.ম. রেজাউল করিম ও আব্দুর রহমান, রেলমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক ও জিল্লুল হাকিম, সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ ও শেখ হাসিনার সাবেক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। তালিকায় রয়েছেন সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ, শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান, বেসামরিক বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী।
সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক সহকারী (পিয়ন) মো. জাহাঙ্গীর আলম, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপ-প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকন,  খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক,  শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি,  ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম। শিক্ষামন্ত্রী মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, ধর্মমন্ত্রী ফরিদুল হক খান, শ্রমমন্ত্রী ইমরান আহমদ, সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন, শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, সাবেক ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল, সাবেক শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু।
তালিকায় আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন- নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, ধীরেন্দ্রনাথ শম্ভু, নিজাম উদ্দিন হাজারী, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ, ড. জান্নাত আরা তালুকদার হেনরী, অসীম কুমার উকিল, অপু উকিল, শাহে আলম তালুকদার, ডা. মনসুর আহমেদ, আবুল কালাম আজাদ, সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার, ইকবালুর রহিম, মো. সাইফুজ্জামান শেখর, তানভীর ইমাম, নজরুল ইসলাম বাবু, শফিকুল ইসলাম শিমুল, নাঈমুর রহমান দুর্জয় ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে তমাল মুনসুর। অন্যদিকে, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ার, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব শাহ কামাল, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ, ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ, এনএসআইয়ের সাবেক ডিজি মেজর জেনারেল (অব.) টি এম জোবায়ের, বিএসএমএমইউয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক কর্মকর্তা মতিউর রহমান, এনবিআরের দ্বিতীয় সচিব আরজিনা খাতুন।
দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা : অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে দেশে-বিদেশে বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়েছেন- এমন অভিযোগের ভিত্তিতে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী দীপু মনি, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, সাবেক শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন, সাবেক নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, সাবেক মন্ত্রী কামরুল ইসলাম, সাবেক শিল্পমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, সাবেক সংসদ সদস্য ছলিম উদ্দিন তরফদার সেলিম, মামুনুর রশিদ কিরণ, কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, কাজিম উদ্দিন, নুর-ই-আলম চৌধুরী ও জিয়াউর রহমান, ঢাকা ওয়াসার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান ও পুলিশ কর্মকর্তা হারুন অর রশীদের বিদেশযাত্রায় আদালতের মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দুদক।
তলবে সাড়া দেননি যারা : অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে গত এক সপ্তাহে ২০ জনকে তলব করলেও তারা দুদকে উপস্থিত হননি। তাদের মধ্যে রয়েছেন- সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমেদ, সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য। এছাড়া সাবেক এমপিদের মধ্যে দুদকে হাজির হননি আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, শেখ হেলাল, সরওয়ার জাহান, শেখ আফিল উদ্দীন ও এনামুল হক। তাদের মধ্যে কেবল সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। এরমধ্যে এনামুল হক ও কামরুল ইসলামের পক্ষে সময়ের আবেদন করলেও তা যথাযথ প্রক্রিয়ায় দাখিল না করায় আমলে নেননি দুদকের অনুসন্ধান টিম।

 

ডেইলি খবর টুয়েন্টিফোর

Link copied!