রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

গ্রাফিন নিয়ে যুদ্ধ চলছে প্রযুক্তিবিশ্বে

ডেইলি খবর ডেস্ক

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৪, ০৫:৩৫ পিএম

গ্রাফিন নিয়ে যুদ্ধ চলছে প্রযুক্তিবিশ্বে

এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে তেল নিয়ে পৃথিবীতে অনেক যুদ্ধ, কূটনৈতিক বিবাদ আর বিভিন্ন দেশের জোট বাঁধার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুটি অর্থনৈতিক শক্তির মধ্যে লড়াই জমে উঠেছে আরেকটি বহুমূল্য সম্পদের জন্য। সেটি হচ্ছে সেমিকন্ডাক্টর বা চিপস, যা আমাদের প্রতিদিনের জীবনে ব্যবহার্য বিভিন্ন জিনিসে শক্তি জোগায়।

একটুখানি সিলিকনের টুকরো দিয়ে তৈরি এই চিপসের বাজার কিন্তু মোটেও ক্ষুদ্র নয়। এই সেমিকন্ডাক্টরের বাজার দুনিয়াব্যাপী ৫০ হাজার কোটি ডলারের, যা ২০৩০ সাল নাগাদ ফুলে-ফেঁপে দ্বিগুণ আকার নেবে। বর্তমানে বিশ্ববাজারে গ্রাফিন নিয়ে চাপ তৈরির চেষ্টা করছে চীন। দেশটির পাঁচ হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠান এখন গ্রাফিননির্ভর পণ্য তৈরিতে কাজ করছে। কয়েক মাস আগে সিলিকনের পরিবর্তে গ্রাফিন ব্যবহার করে মাইক্রোচিপের উৎপাদন বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে চীন। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৫ সালের মধ্যে দেশটি গ্রাফিনের বাজারে বড় জায়গা ধরে ফেলবে।

আন্দ্রে গাইম ও কনস্টান্টিন নভোসেলভ পদার্থবিজ্ঞানের জগতে একেবারে অজ্ঞাতকুলশীল হয়তো নন, কিন্তু ততটা বিখ্যাতও ছিলেন না। বড় কোনো রিসার্চ গ্র্যান্টও তাঁরা পাননি কোনো দিন। তা ছাড়া কোনো সিরিয়াস গবেষণা থেকে নয়, আক্ষরিক অর্থেই ডাস্টবিন থেকে উঠে এসেছে তাঁদের আবিষ্কার। দৈনন্দিন জীবনে ইলেকট্রনিকসের ব্যবহার যত বাড়ছে, ডিভাইসগুলোর ওজন হালকা হচ্ছে। এখন প্লাস্টিকের চেয়েও পাতলা অথচ ইস্পাতের চেয়ে শক্ত, তামার চেয়েও বেশি বিদ্যুৎ পরিবাহী পদার্থ বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন। এই পদার্থগুলো এত পাতলা যে পুরুত্ব নেই বললেই চলে। তাই এগুলোকে দ্বিমাত্রিক পদার্থ বলা হয়। এই পদার্থের জগৎ গ্রাফিনের। এই জগতের সন্ধান আমরা পেয়েছি মাত্র ২০ বছর আগে, ২০০৪ সালে। এই দুজন বিজ্ঞানী আবিষ্কারের মাত্র কয়েক বছরের মাথায় ২০১০ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পান। নমনীয়তা ও শক্তির কারণে বিভিন্ন ইলেকট্রনিকস থেকে শুরু করে মেডিকেল যন্ত্রপাতিতেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে গ্রাফিন। মাইক্রোচিপ নিয়ে শীতল যুদ্ধ চলছে চীনের সঙ্গে যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের। প্রযুক্তিবিশ্বে চলা এই যুদ্ধে নতুন মাত্রা দিয়েছে গ্রাফিন। বর্তমানে সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে সিলিকনের বিকল্প হিসেবে গ্রাফিন ব্যবহার করা হচ্ছে। এ কারণে চীন বিশ্বব্যাপী মাইক্রোচিপের যুদ্ধে এগিয়ে রয়েছে।

গ্রাফিনের একটা ষড়ভুজ আকৃতির কোষে দুটি কার্বন পরমাণু থাকে, যার ক্ষেত্রফল মাত্র ০.০৫২ বর্গন্যানোমিটার। ঘনত্ব ০.৭৭ মিলিগ্রাম/বর্গমিটার। অর্থাৎ ১ মিটার বাই ১ মিটার আকৃতির এক খণ্ড গ্রাফিনের ভর হবে ১ মিলিগ্রামের কম। গ্রাফিন এত পাতলা যে এটা মাত্র ২ দশমিক ৩ শতাংশ আলো শোষণ করে, অর্থাৎ এর মধ্য দিয়ে প্রায় সব আলোই বিনা বাধায় চলে যেতে পারে। গ্রাফিন কাচের মতো স্বচ্ছ। এত পাতলা, এত স্বচ্ছ অথচ গ্রাফিন ইস্পাতের চেয়ে কমপক্ষে ১০০ গুণ শক্ত। এর ভার সইবার ক্ষমতা ৪২ নিউটন/মিটার।

অথচ ইস্পাতের ভার সইবার ক্ষমতা মাত্র ০.৪০ নিউটন/মিটার। ১ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১ মিটার প্রস্থের এক খণ্ড গ্রাফিন দুটি খুঁটির মধ্যে বেঁধে দিলে তার ওপর ৪ কিলোগ্রাম ভর রাখলেও গ্রাফিন খণ্ডটি ছিঁড়বে না। এটা এতই পাতলা যে খালি চোখে একে দেখাই যাবে না। এর ওপর একটা বিড়াল শুয়ে থাকলে মনে হবে বিড়ালটি শূন্যের ওপর শুয়ে আছে। এই গ্রাফিন খণ্ডের ওজন হবে ১ মিলিগ্রামের কম। অথচ বিড়ালের একটা গোঁফের ওজনও ১ মিলিগ্রামের বেশি হবে। গ্রাফিন তামার চেয়ে বিদ্যুৎ সুপরিবাহী এবং এর চেয়ে ১০ গুণ বেশি তাপ পরিবাহী।

তাপ ও বিদ্যুৎ পরিচালনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকর হওয়ায় বৈদ্যুতিক গাড়ির সেন্সরসহ বিভিন্ন যন্ত্র তৈরিতে গ্রাফিন ব্যবহার করা হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, নতুন প্রজন্মের এমআরআই স্ক্যানারের চৌম্বকীয় সেন্সর আর ড্রোন তৈরিতেও গ্রাফিন ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। আর তাই ভবিষ্যৎ ইলেকট্রনিকস শিল্পে গ্রাফিন বিশাল প্রভাব ফেলবে বলে আশা করা হচ্ছে।

যুক্তরাজ্যের প্রযুক্তি উদ্যোক্তা সাইমন থমাস মাইক্রোচিপ তৈরির একটি প্রতিষ্ঠান চালু করেছেন। তিনি জানান, গ্রাফিন একটি বিশেষ উপাদান হিসেবে পরিচিত। এটিকে গ্রাফাইট থেকে নিষ্কাশন করা হয়। গ্রাফাইট কার্বনের স্ফটিক রূপ, যা পেনসিল তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

এই বিশেষ উপাদান মৌলিকভাবে বিশ্বকে পরিবর্তন করতে পারে। স্মার্টফোন, কম্পিউটার থেকে শুরু করে বৈদ্যুতিক গাড়ি, স্বাস্থ্যসেবা ও সামরিক সরঞ্জাম তৈরিতে গ্রাফিন ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। গ্রাফিনের তৈরি স্মার্টফোন কবজিতে পরা যাবে। শুধু তা-ই নয়, মুড়িয়েও রাখা যাবে ট্যাবলেট কম্পিউটার। ভবিষ্যতে গাড়ি, উড়োজাহাজ ও সোলার সেলে গ্রাফিন ব্যবহারের চিন্তা করছেন প্রকৌশলীরা। একই সঙ্গে গ্রাফিন অনেক হালকা। ফলে গ্রাফিন দিয়ে তৈরি যানের জ্বালানি খরচও তুলনামূলক কমে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ভবিষ্যৎ সভ্যতার ইতিহাস লেখার সময় যেসব পদার্থের নাম মানুষের মুখে মুখে থাকবে, সেগুলোর মধ্যে গ্রাফিন থাকবে নিঃসন্দেহে।

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

ডেইলি খবর টুয়েন্টিফোর

Link copied!