হাসিনা সরকারের লুটের রাজত্বে সম্পদ গড়ার প্রতিযোগীতা দলীয় এমপিরা কেউ পিছিয়ে পরেনি। দুহাতে দুর্নীতি-লুটপাট করে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন প্রায় সবাই। নতুনরাও এমপি হয়ে অল্পদিনেই অনেকেই হযেছেন ধনকুবের। যেমন ঢাকার উওরার ভুমিদূশ্য হাবিব হাসান। একাদশ সংসদে তিনি পা রাখেন ‘একাদশে বৃহস্পতি’ হয়ে। সাবেক এমপি এডভোকেট সাহারা খাতুন মারা গেলে শূন্যস্থান পূরণ করেন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাবিব হাসান। তিন বছরের জন্য ক্ষমতা পেয়ে ঢাকা-১৮ আসনের নির্বাচনী এলাকায় যা খুশি তাই-ই করেন। নানা অপকীর্তিতে ডুবে থাকায় দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা তাঁর ওপর থেকে চোখ ফিরিয়ে নেন। ফলে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আর নৌকার টিকিট পাননি। গেল আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের পর গ্রেপ্তারের ভয়ে নিজেকে রেখেছেন লুকিয়ে। তবে উত্তরার অনেক এলাকায় তাঁর ‘সাম্রাজ্য’ এখনও বহাল। তবে তাকে সহায়তাকারী কিছু লুটেরা যৌথঅযিানে ধরা পরেছে।
হাবিব ৩৬ মাস ছিলেন এমপি। এর মধ্যেই নিজের ‘জাত’ চিনিয়ে গেছেন। এলাকার স্কুল-কলেজের ওপর ছিল তাঁর শকুনি চোখ! সরকারিসহ আমজনতার জমি দখল, মার্কেট নিয়ন্ত্রণ, এমনকি নিজ দলের নেতাকর্মীর ওপর হামলায় ছিলেন বেশ দক্ষ! ভুয়া মামলা দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে ‘সুখ’ খুঁজে পেতেন। হাবিব হাসান এতটাই ভয়ংকর যে নিজে উচ্চরক্তচাপের রোগী হয়েও এলাকায় চাপমুক্ত রাখেননি কাউকেই।তার ভয়ে এখনও প্রকাশ্যে তাঁকে নিয়ে মুখ খুলতে সাহস পান না অনেকেই।
নানা ফন্দি-ফিকির করে তিনি কামিয়েছেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। অবৈধ কামাইয়ের টাকায় কানাডার বেগমপাড়ায় ছেলের নামে কেনেন বিলাসবহুল বাড়ি। গত ২২ সেপ্টেম্বর যৌথ বাহিনী অভিযান চালিয়ে হাবিবের ছেলে আবির হাসান তানিমকে উত্তরার ৭ নম্বর সেক্টরের শ্বশুরবাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় ১ কোটি ১৬ লাখ টাকাসহ বিভিন্ন দেশের বিপুল সংখ্যক মুদ্রা ও অস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। এসব অস্ত্র বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমাতে আন্দোলনকারীর ওপর হাবিব হাসানের অনুসারীরা ব্যবহার করে বলে অভিযোগ রয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, এমপি ও মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের পদের অপব্যবহার করে হাবিব নানা দুর্নীতি ও অনৈতিক কার্যক্রম জড়িয়ে নিজের, স্ত্রী-ছেলে ও ভাইদের নামে কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়েন। তাঁর বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ থাকার বিষয়টি তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
সম্পদের রকেট গতি-২০১৫ সালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে প্রার্থী হন হাবিব হাসান। সেই সময় হলফনামায় উল্লেখ করেন শিক্ষাগত যোগ্যতা নবম শ্রেণি পাস। ২০২০ সালে ঢাকা-১৮ আসনের উপনির্বাচনে যখন প্রার্থী হন,তখন ডিঙিয়ে যান এসএসসি। তবে তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন।
শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও হলফনামার হিসাব-কিতাবের অঙ্কে দেখান মুনশিয়ানা। ২০২০ সালের উপনির্বাচনে দেওয়া হলফনামায় যে সম্পদ দেখিয়েছিলেন, ২০২৪ সালের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে গিয়ে সম্পদ দেখান তার চেয়ে ১১ গুণ। তবে সেটা প্রকৃত হিসাব নয় বলে এলাকার মানুষ মনে করেন। শেষ পর্যন্ত প্রার্থিতা থেকে সরে দাঁড়ালেও হলফনামায় তিনি ১৫০ শতাংশ জমির মালিক বলে উল্লেখ করেন। অথচ তাঁর বাবার নামেই বাউনিয়া এলাকায় গড়ে তুলেছেন লতিফ সিটি। সেটাতে জমির পরিমাণ ১১০ বিঘা। নিজের নামে গড়ে তুলেছেন হাবিব সিটি। সেখানেও প্রায় একই পরিমাণ জমি রয়েছে। এগুলো দখল ও জোর করে কম দামে কিনেছিলেন হাবিব।
বেগমপাড়ায় ছেলের নামে বাড়ি-কানাডার টরন্টোর ট্রিনিটি ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে ছেলে আবির হাসান তানিমকে পড়াতে পাঠিয়েছিলেন। ছেলের থাকার জন্য ২০২২ সালে একটি বাড়ি কেনেন। যার দাম বাংলাদেশি টাকায় রেজিস্ট্রেশনের খরচসহ ১৬ কোটি। বাড়িটির অবস্থান টরন্টো শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে স্কারবোরো এলাকার ১৭ কেনস্কট রোডে। বিলাসবহুল এলাকাটি বেগমপাড়া হিসেবে পরিচিত। ছেলের দেশে ফেরার পর থেকে বাড়িটি এক আফগান পরিবারের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়েছে।
অপকর্মের শেষ নেই হাবিবের-এমপি হওয়ার পরই উত্তরার আজমপুরের নবাব হাবিবুল্লাহ স্কুল অ্যান্ড কলেজের নিয়ন্ত্রণ নেন হাবিব। স্কুলের সামনে ১০টা দোকান তৈরি করে পাঁচ কোটি টাকা অগ্রিম নিয়ে ভাড়া দেন। এখন প্রতিটি দোকানের ভাড়া প্রায় ৭০ হাজার টাকা। ভাড়ার টাকার নিয়ন্ত্রণ এখনও হাবিব হাসানের কবজায়। এলাকাবাসী জানান, স্কুল কমিটির সভাপতি পদে মতিউল হক মতিকে বসিয়ে এসব কাজ করেছেন হাবিব।
স্কুলের ভেতরে নিজের একটি ভাস্কর্যও তৈরি করেন। ৫ আগস্টের পর উত্তেজিত জনতা ম্যুরালটি গুঁড়িয়ে দেয়। এ ছাড়া আজমপুর সরকারি স্কুলের সামনে ও পেছনের খালি জায়গায় হোটেল-দোকান বসিয়েছিলেন হাবিব। বিডিআর মার্কেটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সেখান থেকেও প্রতিদিন কমিশন পেয়েছেন। উত্তরা ৮ নম্বর সেক্টরের অটোস্ট্যান্ডের পাশের জায়গায় মার্কেট বানিয়ে সেখান থেকেও মোটা অঙ্কের ফায়দা লুটেছেন। আবদুল্লাহপুর বাজারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সেখান থেকে প্রতিদিন তোলা আড়াই লাখ টাকা ভাগাভাগি হয়েছে স্থানীয় কাউন্সিলর মোতালেবসহ কয়েকজনের সঙ্গে। উত্তরা রাজউক কমার্শিয়াল কমপ্লেক্সের বর্তমান কমিটিকে চাপ দিয়ে দুটি দোকান নিয়ে প্রায় এক কোটি টাকায় মামুন সরকারের কাছে বিক্রি করেন হাবিব।
এ ছাড়া কমপ্লেক্সের পাশে থাকা রাজউক কর্মচারী সমবায় সমিতির পেট্রোলপাম্প দখল করে আব্দুর রব নামে একজনকে দিয়েছেন। সমিতিকে ভাড়া না দিয়েই এখন পাম্পটি তিনি চালাচ্ছেন। মাজেদ খান নামে একজনকে সঙ্গে নিয়ে রাজউকের জায়গা দখল করে সেখানে দোকানপাট বসিয়ে ভাড়া আদায় করেছেন হাবিব। উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরে অতীশ দীপঙ্কর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের জমি দখল করে সেখানে অর্ধশত দোকান বানিয়ে মোটা অঙ্কের ফায়দা লুটেন তিনি। বাউনিয়া থেকে উত্তরা ১৭ নম্বর সেক্টর পর্যন্ত বিভিন্ন মানুষের জমি দখল বা কম দামে কিনে গড়ে তুলেছেন দুটি আবাসন প্রকল্প। একটি তাঁর বাবার নামে লতিফ সিটি। আরেকটি নিজের নামে।
ভুক্তভোগীর অভিযোগ, কাঠাপ্রতি পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকার বিনিময়ে নিজ নামে লিখে নেওয়ার প্রস্তাব দেন হাবিব। কেউ বিক্রি করতে আপত্তি জানালে তাঁকে ভয়, হুমকি ও মামলা দেওয়ার কথা বলে জমি দখল করেন। অনেকের কাছ থেকে জমি রেজিস্ট্রি করে নির্ধারিত টাকার অর্ধেক পরিশোধ করেন। হাবিব ও তাঁর ক্যাডার বাহিনীর দাপটের কারণে প্রকৃত মালিক তাদের জমির ধারেকাছেও যাওার সুযোগ পাননি।
সাহারার অনুসারীদের ওপর পীড়ন-হাবিব এমপি হওয়ার পরই বলতে থাকেন সাহারা খাতুনের অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে চান। আদতে তিনি সাহারা অনুসারীর দমন শুরু করেন। হাবিবের দখল-অপশাসনের প্রতিবাদ করায় তুরাগ থানা যুবলীগ নেতা সফিউর রহমানের চাচার নামে মিথ্যা মামলা দেন হাবিব। এর প্রতিবাদ করায় সফিউর রহমানসহ তাঁর বাবার নামে আরেকটি মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠান। সাহারার অনুসারী হওয়ায় হাবিব এ কাজ করেছেন বলে অভিযোগ সফিউর রহমানের। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ আমলে আমার মনে হয়েছে, আমি বিএনপির লোক।’
সাহারার আরেক অনুসারী মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি নূর হোসেনকে এক মারামারির ঘটনায় ১ নম্বর আসামি করে মামলা দেন হাবিব। খিলক্ষেত থানা যুবলীগ নেতা শাহীন মিয়া সাহারার অনুসারী হওয়ায় তাঁর মা ও চাচার নামে দুই কোটি টাকার অর্থ আত্মসাতের মামলা দেওয়া হয়।
ভুক্তভোগী রমজান মিয়া জানান, একটি জমির ওপর আদালতের স্থিতাবস্থার আদেশ ছিল। কিন্তু মামলার সুরাহার আগেই হাবিবের ভাই নাদিম মাহমুদ ওই জমি দখল করে নেন। ভুক্তভোগী খোরশেদ আলম বলেন, ‘একটি জমি নিয়ে দুই পক্ষের মামলা ছিল। এক পর্যায়ে মামলাটিতে আমি জিতি। তার পরই হাবিবের ভাই নাদিম মাহমুদ সেখানে ঢুকে ভরাট শুরু করেন। পুলিশের কাছে গিয়ে বললেও থানা হাবিবের কথারই গুরুত্ব দেয়।’
হরিরামপুর থানা যুবলীগ নেতা আতাউর রহমানের ৩ কোটি টাকার জমি ১ কোটি টাকা দিয়ে জোর করে লিখে নেন হাবিব। ক্যান্সার আক্রান্ত আতাউর রহমান চিকিৎসার জন্য জমির কিছু অংশ বিক্রির উদ্যোগ নিলে হাবিব পুরোটাই পানির দামে নিয়ে নেন। কেনার সময় বলে যান, নির্বাচনে তাঁর অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। আর টাকা দিতে পারবেন না। আতাউর রহমান না মানলে তাঁর নামে তিনটি মামলা ঠুঁকে দেন। প্রভাব খাটিয়ে ওই মামলায় আতাউরকে জেলেও পাঠান হাবিব।
বলপ্রয়োগের হাতিয়ার ভাই-চার ভাইয়ের মধ্যে হাবিব হাসান ছিলেন মেজো। বড় ভাই মারা গেছেন। সেজো ভাই হাদিম, ছোট ভাই সোহেল। এমপি হওয়ার পর থেকেই জনকল্যাণমূলক কাজে মন না দিয়ে চাঁদাবাজির দিকে মনোনিবেশ করেন। আর হাবিবের ক্ষমতা সমানতালে ব্যবহার করতেন তাঁর ছোট ভাই সালাউদ্দিন সোহেল। হাবিবের ছোট ভাই যে জায়গায় থাবা বসিয়েছেন, সেগুলো হলো উত্তরায় অবৈধ কাঁচাবাজার, পরিবহনে চাঁদাবাজি (লেগুনা-অটোরিকশা),ডিশ-ইন্টারনেট, ফুটপাত, পদবাণিজ্য, সেক্টর কল্যাণ সমিতির নির্বাচন না দিয়ে কমিটি ঘোষণা,বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রোগ্রামে ডেকোরেটরের কাজের টাকা না দেওয়া, হোটেল, রেস্তোরাঁ, ফার্নিচার মার্কেট, স্কুল-কলেজে চাঁদাবাজি, অবৈধ বিদ্যুৎ-গ্যাস সংযোগ ভাড়া,ময়লা পরিষ্কারের বখরা উল্লেখযোগ্য। স্থানীয় বাসিন্দারা জায়গা বিক্রি করলেও সেখান থেকে হাবিবের হয়ে সোহেল কমিশন নিতেন। উত্তরার বাউনিয়ায় ভূমি দখল করে মার্কেট নির্মাণ করেন হাবিব।উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের সোনারগাঁও জনপথ রোডে রাজউকের খালি প্লটের ফার্নিচার মার্কেট প্রতিষ্ঠা করেন সোহেল। সেখানে প্রায় ২০০টি ফার্নিচারের দোকান থেকে মাসে ভাড়া নিতেন সোহেল,যা এখন স্থানীয় বিএনপি ও তাদের সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীর নিয়ন্ত্রণে,হাবিব বাহিনীর দৌরাত্ম্য-জমি দখলে হাবিবের ধান হাতিয়ার ছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেন। ফার্নিচার মার্কেটের চাঁদাবাজিতে যুক্ত ছিলেন ৫১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর শরীফুল ইসলাম ও তাঁর অনুসারীরা। আবদুল্লাহপুর মাছ বাজারের চাঁদাবাজিতে যুক্ত হাবিবের অনুসারী কাউন্সিলর মোতালেব। উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টরসংলগ্ন কাঁচাবাজার থেকে চাঁদা তুলতেন ‘আয়নাবাজ’খ্যাত নাজমুল। গত ৫ আগস্টের পর সাবেক এমপি হাবিব হাসানসহ তাঁর সব স্বজন পলাতক। বিভিন্নভাবে তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে কারোর সঙ্গে কথা বলা যায়নি। রাজনীতিকে চাঁদাবাজি-ভুমিদখলের হাতিয়ারকরাসহ ব্যবসায় পরিণত করা হাবিব স্থানীয় জনগনের সেবায় তার কোনো মনোযোগ দেখেনি এলাকার জনগন।
আপনার মতামত লিখুন :