মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১

স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েই দুর্নীতির সিন্ডিকেট গড়ে তুলে জাহিদ মালেক

আইন-অপরাধ ডেস্ক

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৬, ২০২৪, ১১:৪৯ এএম

স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েই দুর্নীতির সিন্ডিকেট গড়ে তুলে জাহিদ মালেক

শেখ হাসিনা সরকারের দুবারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপনের কাজই ছিল সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বিভিন্ন হাসপাতালের কেনাকাটা, নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, পদায়ন, ওষুধ ও চিকিৎসা যন্ত্রপাতি সরবরাহ, অবকাঠামো উন্নয়নসহ সব কাজেই ভাগ বসানো। মন্ত্রিত্বকে আখের গোছানোর হাতিয়ার বানিয়ে শত শত কোটি টাকা হাতিয়েছেন জাহিদ মালেক ওরফে স্বপন। করোনাকালে টিকা, টেস্ট কিট, নকল মাস্ক বানিয়ে ও ভুয়া আমদানি দেখিয়ে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে সাবেক এই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েই দুর্নীতির অর্থে ব্যক্তিগত স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন করেন এই জাহিদ মালেক স্বপন।
দুর্নীতির টাকায় নামে-বেনামে এক ডজনের বেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। ঢাকার গুলশানে আলিশান বাড়ি, গ্রামের বাড়িতে মায়ের নামে বিশাল বাগানবাড়ি এবং এগ্রো ফার্ম তৈরি করেছেন। তা ছাড়া বনানীতে ১৪ তলা ও মানিকগঞ্জে ১০ তলা বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করেছেন। সভা-সেমিনার করতে মানিকগঞ্জে ছেলের নামে করেছেন বিশাল মিলনায়তন ‘শুভ্র সেন্টার’।
এরই মধ্যে সাবেক মন্ত্রী জাহিদ মালেক এবং তার ছেলেমেয়ের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে তাদের মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত করা হয়েছে। এই দুর্নীতিবাজের।
করোনাকালে মুন্সীগঞ্জের একটি কারখানায় এন-৯৫ নকল মাস্ক বানিয়ে ভুয়া আমদানি দেখিয়েছেন। এসব মাস্ক হাসপাতালের চিকিৎসকদের দেওয়া হতো। এই কাজটির সঙ্গে সরাসরি সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ছেলে রাহাত মালিক, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আসাদুল ইসলাম আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ডা. আবুল কালাম আজাদ মিলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জেএমআই গ্রæপের মাধ্যমে করে কয়েকশ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। সেই সময় টিআইবির এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ‘স্বাস্থ্য খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অযোগ্যতার কারণে করোনাভাইরাস সংকট প্রকট হচ্ছে। এই দুর্যোগকালীন পরিস্থিতিতে ৫ থেকে ১০ গুণ বাড়তি দামে মানহীন মাস্ক, পিপিইসহ সুরক্ষা সামগ্রী সরকারিভাবে সরবরাহ করা হচ্ছে।’
টিআইবি অভিযোগ করে, একটি সিন্ডিকেট বিভিন্ন ফার্মের নামে সব ধরনের কেনাকাটা নিয়ন্ত্রণ করছে এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের একাংশ এতে জড়িত রয়েছে। বিভিন্ন হাসপাতালে এন-৯৫ মাস্ক লেখা মোড়কে সাধারণ সার্জিক্যাল মাস্ক সরবরাহ করার বিষয়কে তুলে ধরা হয়েছে। করোনাভাইরাস পরীক্ষার রক্ত সংগ্রহের টিউব, সিরিঞ্জ থেকে শুরু করে পিসিআর মেশিন কেনাসহ বিভিন্ন চিকিৎসা সামগ্রীর ক্ষেত্রে নানা ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়ার কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
২০১৯ সালের ২ ফেব্রæয়ারি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তৎকালীন কমিশনার (অনুসন্ধান) মোজাম্মেল হক খান তৎকালীন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেকের হাতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন তুলে দেন। প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য খাতে কেনাকাটা, নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, পদায়ন, চিকিৎসাসেবা, চিকিৎসাসেবায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ব্যবহার, ওষুধ সরবরাহসহ ১১টি দুর্নীতির উৎসের উল্লেখ ছিল। তবে প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী।
২০২০ সালের ৮ মার্চ থেকে দেশে ভয়াবহ করোনা মহামারি শুরু হয়। এই মহামারি মোকাবিলার মূল দায়িত্ব ছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। এই কঠিন সময়ে একে একে ঘটল সাহেদ করিম, সাবরিনা-কান্ড, পিপিই-মাস্ক কলেঙ্কারি। এই প্রেক্ষাপটে দুদক ২০২০ সালের জুন মাসে ফের তদন্তে নামে এবং মাস্ক, পিপিই, স্যানিটাইজার, আইসিইউ সরঞ্জাম, ভেন্টিলেটর, পিসিআর মেশিন ও টেস্ট কিট সংগ্রহে গৃহীত প্রকল্পগুলোর ব্যাপারে তথ্য চেয়ে চিঠি দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে।
এরপর ২০২১ সালের ৮ জুন ‘করোনাভাইরাস সংকট মোকাবিলা: কভিড-১৯ টিকা ব্যবস্থাপনায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে টিআইবি। দেশের আট বিভাগের ৪৩ জেলার ১ হাজার ৩৮৭ জনের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তৈরি এই প্রতিবেদনে টিকা নিতে গিয়ে তারা কী কী সমস্যায় পড়েছেন, তা প্রতিফলিত হয়েছে এতে। টিআইবি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি-অনিয়ম তুলে ধরে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ১২ জুন এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক তার মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে ওঠা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন।
জাহিদ মালেকের যত সম্পদ:জাহিদ মালেক ১৯৮৪ সালে বাবার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায় কর্মজীবন শুরু করেন। রাজনীতির পাশাপাশি নতুন নতুন ব্যবসায় হাত দেন। বাবা আব্দুল মালেকের দিকনির্দেশনায় গড়ে তোলেন বাংলাদেশ থাই অ্যালুমিনিয়াম লিমিটেড, সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড, বিডি থাইফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড, রাহাত রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেড, বিডি সানলাইফ ব্রোকারেজ হাউস লিমিটেডের মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠান। ১৯৮৪ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এলাকাবাসী জানান, স্কুল করার কথা বলে মানুষের জমি নিয়ে মায়ের নামে গড়েছেন বিশাল বাগান বাড়ি এবং এগ্রো ফার্ম। জমি দখলে সন্ত্রাসী বাহিনী ব্যবহার করলেও মালিকদের ন্যায্য দাম দেননি।
সম্পদ বেড়েছে ১১ গুণ:মানিকগঞ্জ-৩ (সদর ও সাটুরিয়া) আসনের প্রার্থী জাহিদ মালেকের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রথমবারের মতো জয় লাভ করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর পর থেকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত তার আয় ও সম্পদ বেড়েছে প্রায় ১১ গুণ। ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান এবং ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে দায়িত্ব পান স্বাস্থ্যমন্ত্রীর। মানিকগঞ্জ-৩ আসনের জাহিদ মালেকের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, তার আয় ও সম্পদ বেড়েছে দশ গুণেরও বেশি। বার্ষিক আয়ের উৎস হিসেবে রয়েছে বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট, দোকান ভাড়া, এগ্রো ফার্ম, শেয়ার, সঞ্চয়পত্র এবং ব্যাংক আমানত। এসব স্থান থেকে বছরে ৮ কোটি ২৯ লাখ ৯৭ হাজার ২৫ টাকা আয় করেন তিনি, যা ২০০৮ সালে ছিল ৭১ লাখ ৩৪ হাজার ৬৯১ টাকা। গত ১৫ বছরে তার বার্ষিক আয় বেড়েছে ১১ দশমিক ৬৩ গুণ। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় নগদ টাকা, বৈদেশিক মুদ্রা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা টাকা, বন্ড ও ঋণপত্র, যানবাহন ও অন্যান্য বাবদ তার অস্থাবর সম্পদের আর্থিক মূল্য ৭০ কোটি ৩৩ লাখ ৬৬ হাজার ৬৬১ টাকা। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় জাহিদ মালেকের নামে অকৃষি জমি ছিল ২ দশমিক ৫ কাঠা এবং তার স্ত্রীর ছিল ২ দশমিক ৫ কাঠা। এ ছাড়া ৫৩ দশমিক ৪ শতক জমিতে ১১ তলা আবাসিক বা বাণিজ্যিক ভবন এবং বাড়ি ছিল স্বাস্থ্যমন্ত্রীর। যৌথ মালিকানায় ৪০ বিঘা কৃষিজমি ছিল।
জমি অধিগ্রহণেই শতকোটি:রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন একমাত্র ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের (ইডিসিএল) নতুন প্লান্ট স্থাপনে মানিকগঞ্জ সদর উপজেলায় সাড়ে ৩১ একর নিচু জমি নির্বাচন করেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। নিচু জমি ভরাট করে ভিটার মূল্য হারে টাকা আদায়ের ছক কষেন। এতে সরকারের কাছ থেকে প্রায় ১০০ কোটি টাকা বেশি আদায় করা হতো। তবে মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসকের প্রতিবেদনে এই নীলনকশা ফাঁস হয়। মানিকগঞ্জের তৎকালীন জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ আব্দুল লতিফ ২০২৩ সালের ১৫ ফেব্রæয়ারি স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবকে পাঠানো প্রতিবেদনে জানান, ইডিসিএলের ওই প্রকল্প বাস্তবায়নে মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার ৮৪ নম্বর মেঘশিমুল মৌজায় ৩১ দশমিক ৫ একর জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব পাওয়া গেছে। জমি অধিগ্রহণে এর আগে (২৭ ডিসেম্বর ২০২২) সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। ১৭ জানুয়ারি জেলা ভূমি বরাদ্দ কমিটির সভার সিদ্ধান্ত ও দাখিলকৃত রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রস্তাবিত ভূমির শ্রেণি নাল (নিচু) হলেও সম্প্রতি সেখানে বালু ভরাট করে ভিটা শ্রেণি (উঁচু) করা হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, জেলার অন্য কোনো মৌজায় দাম পরিবর্তন না করলেও ২০২১ সালের ১১ জানুয়ারি পরিকল্পিতভাবে মহাপরিদর্শক নিবন্ধনের স্মারক নম্বর ১০.০৫.০০০০.০০৪.৯৯.২১. ৭৭ এবং ১৮ জানুয়ারি ২০২১ সালে জেলা রেজিস্ট্রার, মানিকগঞ্জের স্মারক নম্বর ৪১-এ মূলে শুধু ৮৪ নম্বর মেঘশিমুল মৌজার ভিটা/ বাড়ি শ্রেণির সরকারি মূল্য ২৫ হাজার টাকার পরিবর্তে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়। আশপাশের মৌজার রেট অনেক কম। এটি সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করা হয়েছে। প্রতিবেদনে ডিসি মন্তব্য করেন, প্রকল্পের জন্য মেঘশিমুল মৌজায় ভিটা শ্রেণির (পরিবর্তন করা) জমি অধিগ্রহণ করা হলে পার্শ্ববর্তী মৌজার চেয়ে সরকারের ৩ থেকে ১০ গুণ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হবে। এর পরিমাণ ৬০ থেকে ১০০ কোটি টাকা।
জমি, ভবনসহ প্রেসক্রিপশন পয়েন্ট দখলে রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার: ২০২৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর বনানীর প্রেসক্রিপশন পয়েন্ট ও ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড কনসালটেশন সেন্টার বন্ধ করে দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ সময় প্রতিষ্ঠানটিতে তালা দেওয়া হয়। তবে কী কারণে সেটি বন্ধ করা হয়, সে বিষয়ে অধিদপ্তরের কোনো কর্মকর্তা সে সময় মুখ খোলেননি। ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পরিচালক খন্দকার আশফাক অভিযোগ করেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে কিছু ব্যক্তির ইন্ধনে অবৈধভাবে বন্ধ থাকা ক্লিনিকে পরিদর্শনের নামে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওই বছরের ১৮ মে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি পরিদর্শক দল প্রেসক্রিপশন পয়েন্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টার পরিদর্শন করে। পরে একই মাসের ২২ তারিখ পেছনের তারিখ দেখিয়ে একটি চিঠিতে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন আইন অমান্য;অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের মাধ্যমে জনগণের হয়রানি; মেয়াদ উত্তীর্ণ রি-এজেন্ট এবং অদক্ষ জনবলের মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার অভিযোগ আনা হয়। তবে মূল ঘটনা হলো, তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের ছেলে রাহাত মালেক প্রেসক্রিপশন পয়েন্ট ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে বছরের শুরুর দিকে জানান, যে ভবনে ডায়াগনস্টিক সেন্টারটি পরিচালিত হচ্ছে, সেই জায়গাটি তিনি কিনে নিতে বায়না করেছেন। তাই জায়গাটি ছেড়ে দেওয়া উত্তম হবে। সেটি না হলে তাকে (রাহাত মালেক) যেন উপর্যুক্ত শেয়ার দিয়ে প্রেসক্রিপশন পয়েন্ট লিমিটেডের মালিকানায় যুক্ত করা হয়। এরপর ঘটে বিস্ময়কর কিছু ঘটনা। বনানীর ১২ নম্বর রোডে একাধিক বাণিজ্যিক, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থাকলেও শুধু প্রেসক্রিপশন সেন্টার লিমিটেডের কার্যক্রম বন্ধ করতে তৎপর হয় রাজউক, ডেসকো। ২০২৩ সালের ২৭ আগস্ট ডেসকোর নির্বাহী প্রকৌশলী এস এম শাহ সুলতান এক চিঠি দিয়ে প্রেসক্রিপশন পয়েন্ট কর্তৃপক্ষকে আবাসিক ভবনে বিধিবহির্ভূতভাবে বাণিজ্যিক কার্যক্রমে বিদ্যুৎ ব্যবহার না করার নির্দেশ দেয়। এর আগে ১৯ জুন রাজউক কর্তৃপক্ষ প্রেসক্রিপশন পয়েন্টকে বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধের চিঠি দেয়। মূলত প্রেসক্রিপশন পয়েন্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টোরের জমিসহ ভবনটি ওই বছরের ১৮ জানুয়ারি ৬ কোটি টাকা দলিলমূল্যে কিনে নেয় ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের পক্ষে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ইমরান মুস্তাফিজ। যিনি রাহাত মালেকের ঘনিষ্ঠ।
প্রশিক্ষণের নামে লোপাট ৮ কোটি:স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে বৈদেশিক প্রশিক্ষণের জন্য ১৯টি বিষয়ের আওতায় ৩১ প্যাকেজে ৪২৬ জনের নামে সরকারি আদেশ (জিও) জারি করা হয়। প্রশিক্ষণার্থীদের সম্মানী ভাতা বাবদ কোটি ৯৭ লাখ ৯৭ হাজার ৬৭৫ টাকা, বিমান ভাড়া ২ কোটি ২৭ লাখ ৮৬ হাজার টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। এর বাইরে প্রশিক্ষণ, প্রতিষ্ঠানিক ও কর্মসূচি উন্নয়ন ব্যয় হিসেবে ১৪ কোটি ৩৭ লাখ ১১ হাজার ৪৭২ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। সব মিলে বিদেশে প্রশিক্ষণ বাবদ ২১ কোটি ৭২ লাখ ঊনত্রিশ হাজার ১৪৭ টাকা ব্যয় নির্ধারণ করা হয়। প্রতিটি দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপক, কর্মচারীসহ সব প্রশিক্ষণার্থীর জন্য সমপরিমাণ কর্মসূচি উন্নয়ন ব্যয় জনপ্রতি ৪ হাজার ডলার ধরা হয়েছে, যা বাস্তবসম্মত নয়। অথচ আগের বছরগুলোতে একই কর্মসূচিতে গড়ে জনপ্রতি দেড় থেকে ২ হাজার ডলার ব্যয় হতো। প্রশিক্ষণের নামে জনপ্রতি গড়ে ২ হাজার ডলার অতিরিক্ত ব্যয় ধরা হয়। এই প্রক্রিয়ায় ৭ থেকে ৮ কোটি টাকা অভিযুক্ত ব্যক্তিরা আত্মসাৎ করেন। অভিযোগে বলা হয়, প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই মানসম্মত নয়। ওইসব প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার না করে অন্য অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানো হয়েছে। এসব অ্যাকাউন্ট থেকে অতিরিক্ত পাঠানো টাকা হুন্ডির মাধ্যমে দেশে ফেরত আনা হয়েছে। এই ঘটনায় সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের এপিএস আরিফুর রহমানকে ২০২০ সালের ১৪ জানুয়ারি তলব করে চিঠি দেন দুদকের তৎকালীন উপপরিচালক মো. সামছুল আলম। ওই চিঠিতে তাকে ২০ জানুয়ারি দুদকে হাজির হতে বলা হয়। চিঠি পেয়ে আরিফুর রহমান সেখ দুদকে সময়ের আবেদন করেন। এ ঘটনায় আরিফুর রহমান ফেঁসে গেলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন জাহিদ মালেক। আরিফুর রহমান সেখকে তলবের চিঠি দেওয়ার পরদিনই এপিএসের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ১৫ জানুয়ারি মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের প্রশাসন-১ শাখার সিনিয়র সহকারী সচিব শাহাদত হোসেন কবির স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে এই অব্যাহতি দেওয়া হয়। তবে এরপর জাহিদ মালেকের প্রত্যক্ষ মদদে আরিফ হয়ে ওঠেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারক।
হয়রানির শিকার ইন্স্যুরেন্সের লাখ লাখ গ্রাহক:ক্ষমতার অপব্যবহার করে সারা দেশের লাখ লাখ গ্রাহককে হয়রানি করছে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। গ্রাহকের টাকা দিতে না পারায় সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সে কোম্পানির চেয়ারম্যান, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও), ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও উপব্যবস্থাপনা পরিচালকের (ডিএমডি) বিরুদ্ধে প্রতারণা মামলা হয়। আদালত সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান ড.রুবিনা হামিদ, সিইও মোহম্মদ নূরুল ইসলাম, ডিএমডি সুমনা পারভীনসহ তিনজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।
জানা যায়, ২০১৩ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বীমা কোম্পানিটি সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান। এটির চেয়ারম্যান মন্ত্রীর বোন অধ্যাপক রুবিনা হামিদ। পরিচালক হিসেবে রয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর স্ত্রী শাবানা মালেক, ছেলে রাহাত মালেক ও বোন রুবিনা হামিদের স্বামী কাজী আখতার হামিদ। রুবিনা হামিদের আগে জাহিদ মালেক কোম্পানির চেয়ারম্যান ছিলেন। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষে (আইডিআরএ) এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৯ সাল পর্যন্ত নিরীক্ষিত হিসাব অনুসারে কোম্পানিটির লাইফ ফান্ড ছিল ১৯২ কোটি ১৫ লাখ টাকা। ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৮৯ কোটি ৭৭ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করেছে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। আইন অনুসারে কোম্পানিটি ব্যবসা পরিচালনায় যে ব্যয় করতে পারে, তার চেয়ে বেশি ব্যয় করেছে। অতিরিক্ত ব্যয় করা এসব টাকার ৯০ শতাংশই বীমা গ্রাহকের জমাকৃত টাকা। এ কারণে গ্রাহকদের পাওনা টাকা পরিশোধ করতে পারেনি। স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ হলেও হাসিনা সরকার কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। দুর্নীতির অভিযোগ করলে যে করেন তার বিরুদ্ধেই উল্টো হয়রানি করা হতো।

 

ডেইলি খবর টুয়েন্টিফোর

Link copied!