শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

রেলের পূর্বাঞ্চলের ৯৭ লাখ টাকা মেরে দিলো কে?

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি

প্রকাশিত: মার্চ ২৭, ২০২৪, ০১:৪৭ পিএম

রেলের পূর্বাঞ্চলের ৯৭ লাখ টাকা মেরে দিলো কে?


জিএম জাহাঙ্গীর আলম দায়িত্ব থাকাকালীন বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়া হয়েছিল। অবসওে যাওয়ার পরে প্রকাশ পেলে ৯৭ লাখ টাকা ভুয়া বিল ভাউচার কওে এ তুলে আত্মসাৎ করা হয়েছে। বিষয়টি সাবেক জিএম জানেন না এমন প্রশ্ন কর্মরতরা কেউ বিশ^াস করছেনা।  তাহলে কার পকেটে গেলো চট্টগ্রাম রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের ভুয়া বিল-ভাউচারে তুলে নেওয়া ৯৬ লাখ ৯০ হাজার টাকা। সরকারি এই অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে নেওয়া হয়নি কোনও ব্যবস্থা। এমনকি এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত থানায় মামলাও হয়নি। 
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেলওয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, ‘এই টাকা আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সাবেক জিএম জাহাঙ্গীর আলম ও প্রধান অর্থ উপদেষ্টা হিসাব কর্মকর্তা রফিকুল বারী খানের দফতরের অস্থায়ী কম্পিউটার অপারেটর হাবিবুল্লাহ খান হাবিব। এরমধ্যে হাবিবকে দিয়ে বিল পাসের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভারে ঢুকে এন্ট্রি দিয়েছেন। লুটের তথ্য ফাঁস হওয়ার পর থেকে হাবিব কর্মস্থলে অনুপস্থিত, পলাতক রয়েছেন।’ পূর্বাঞ্চলের সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রকের দফতর সূত্র জানায়, গেলো অর্থবছরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স দি কসমোপলিটন করপোরেশনের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে রেলের বেশ কিছু সরঞ্জাম কেনা হয়। এর মধ্যে চারটি কাজের বিল তিন কোটি ৬২ লাখ টাকা কসমোপলিটনকে পরিশোধের জন্য হিসাব বিভাগকে চিঠি দেন প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক ফরিদ উদ্দীন। সে টাকা তুলে নেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তবে সমস্যা সৃষ্টি হয় এই টাকার বাইরে আরও ৯৬ লাখ ৯০ হাজার টাকা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে তুলে নেওয়া হয়। রেলওয়েকে কোনও পণ্য না দিয়ে এত টাকা নিয়ে যাওয়ায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। আলোচনা-সমালোচনার মুখে গত ৮ ফেব্রæয়ারি ঘটনা তদন্তে চার সদস্যের কমিটি গঠন করে রেলওয়ে। রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা জয়শ্রী মজুমদার রশ্মিকে কমিটির আহ্বায়ক করা হয়। এছাড়া হিসাবরক্ষক আব্দুল্লাহ আল আসিফকে সদস্যসচিব, সুগ্রীব চাকমা ও মো. জহিরুল ইসলামকে সদস্য করা হয়। কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু কমিটি নির্দিষ্ট সময়ের ১৫ দিন পরে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তদন্ত কমিটির এক সদস্য বলেন, ‘তদন্তে টাকা আত্মসাতে হাবিবের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। তার সঙ্গে আর কারা জড়িত, তাও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান অর্থ উপদেষ্টা ও হিসাব কর্মকর্তা রফিকুল বারী খান কোনও কথা বলতে রাজি হননি। তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা জয়শ্রী মজুমদার রশ্মি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। তদন্তে যা পেয়েছি, তাই প্রতিবেদনে তুলে ধরেছি। এ বিষয়ে কী অবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা আমার জানা নেই।’ তবে প্রতিবেদনে কার সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ করেছেন, তা জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন জয়শ্রী মজুমদার।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সহকারী অর্থ উপদেষ্টা ও হিসাব কর্মকর্তা মো. সোহাগ মীর বলেন, ‘তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের আলোকে মামলা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আমাকে বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় মামলা করার জন্য রেলের কর্মকর্তারা বলেছেন। ইতোমধ্যে তিনবার মামলা করার জন্য কোতোয়ালি থানায় গিয়েছি। তবে থানা পুলিশ মামলা নেয়নি। সর্বশেষ একটি জিডি নিয়েছে। যার নম্বর-২০২৭।’
তদন্ত প্রতিবেদনে রফিকুল বারী খানের দফতরের অস্থায়ী কম্পিউটার অপারেটর হাবিবুল্লাহ খান হাবিবকে এই  টাকা আত্মসাতের জন্য দায়ী করা হয়েছে উল্লেখ করে সোহাগ মীর বলেন, ‘হাবিব ঘটনার পর থেকে পলাতক আছেন। এর সঙ্গে সীমান্ত ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার কর্মকর্তাদের যোগসূত্র পেয়েছে তদন্ত কমিটি। এ কারণে মামলার আবেদনে হাবিবের পাশাপাশি সীমান্ত ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার কর্মকর্তাদেরও আসামি হিসেবে রাখা হয়। এছাড়া মামলার আবেদনে আরও অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করা হয়।’
কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম ওবায়েদুল হক বলেন, ‘রেলওয়ের টাকা আত্মসাতের ঘটনায় এখন পর্যন্ত মামলা হয়নি। এই মামলা নেওয়া থানা পুলিশের এখতিয়ারভুক্ত নয়, সরকারি অফিসের টাকা আত্মসাতের বিষয়টি দুদকের এখতিয়ারভুক্ত। এ কারণে মামলা থানায় নয়, দুদকে করতে হবে। রেলওয়ে কর্মকর্তাদের একাধিকবার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এরপরও তারা দুদক কার্যালয়ে না গিয়ে থানায় মামলা করার চেষ্টা করছেন।’
এদিকে গত ১১ ফেব্রæয়ারি রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত অর্থ উপদেষ্টা ও প্রধান হিসাব অধিকর্তা মো. সাইদুর রহমান সরকার স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়, ৭ ফেব্রæয়ারি বাজেট ও খরচের হিসাব সমন্বয়কালে দেখা যায়, গত ২৮ ডিসেম্বর মেসার্স দি কসমোপলিটন করপোরেশনের নামে চারটি বিলের অতিরিক্ত ৯৬ লাখ ৯০ হাজার টাকার একটি সন্দেহজনক বিল পরিশোধ করা হয়েছে। যা গুরুতর আর্থিক অনিয়মের পর্যায়ভুক্ত। ওই বিল পাস ও চেকের মাধ্যমে পরিশোধের সঙ্গে নিম্নবর্ণিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। বিষয়টি সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে সাত কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্থ করা হলো। বরখাস্ত হওয়া সাত কর্মকর্তা-কর্মচারী হলেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের হিসাবরক্ষক মামুন হোসেন, মো. আবু নাছের, শিমুল বেগম, সৈয়দ সাইফুর রহমান, অডিটর পবন কুমার পালিত, জুনিয়র অডিটর ইকবাল মো. রেজাউল করিম ও অফিস সহায়ক মাকসুদুর রহমান।
রলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক ফরিদ উদ্দীন বলেন, ‘চারটি কাজের বিল তিন কোটি ৬২ লাখ টাকা কসমোপলিটনকে পরিশোধের জন্য হিসাব বিভাগকে আমার দফতর থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। তবে ৯৬ লাখ ৯০ হাজার টাকার বিলের বিষয়ে আমার দফতর থেকে কোনও চিঠি দেওয়া হয়নি। এমনকি চেক পরিশোধের জন্য কোনও কাগজপত্র জমা দেওয়া হয়নি। কোনও কাগজপত্র ছাড়া যাচাই-বাছাই না করে কীভাবে এত টাকার চেক পাস হলো, বিষয়টি সম্পর্কে ভালো বলতে পারবে অর্থ বিভাগ।’
রলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বর্তমানের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘অর্থ বিভাগ থেকে ৯৭ লাখ টাকা আত্মসাতের ঘটনায় গঠিত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। আমি নিদর্শনা দিয়েছি যারা অর্থ আত্মসাতে জড়িত তাদের যেন আইনের আওতায় আনা হয়। তারা যাতে কঠোর শাস্তি পায়। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে।’ অভিযোগ আছে সাবেক জিএম জাহাঙ্গীর আলম দায়িত্বে থাকাকালীন ঠিকাদারদের সাথে যোগসাজেসে এলটিএমের মাধ্যমে তার পরিচিত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার কাজ পাওয়ে দিয়ে লাখ লাখ টাকা কমিশন আদায় করেছেন। নানারকম অভিযোগ নিয়ে সাবেক মহাব্যবস্থাপক (জিএম) জাহাঙ্গীর আলমের সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

 

ডেইলি খবর টুয়েন্টিফোর

Link copied!