চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে নিজেই ব্যবসা করেছেন রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশনের (পিডিবিএফ) সাবেক ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আমিনুল ইসলাম। পাশাপাশি তিনি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অনৈতিক আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন।
এমনকি টাকার বিনিময়ে প্রতিষ্ঠানের সাজাপ্রাপ্ত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ ও লোভনীয় পদে পোস্টিং (পদায়ন) দিয়েছেন। বর্তমানে আমিনুল ইসলাম পিডিবিএফের দ্বিতীয় শীর্ষ পদ পরিচালক (মাঠ পরিচালন) পদে কর্মরত। পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য। প্রতিবেদনটি সম্প্রতি পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব ড. রেজাউল আহসানের কাছে জমা দিয়েছেন কমিটির প্রধান সদ্য অবসরে যাওয়া অতিরিক্ত সচিব খালিদ পারভেজ খান।
এদিকে আমিনুল ইসলামের অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্ত করতে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত ২ ফেব্রুয়ারি উল্লিখিত বিষয়সহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির সব নথি চেয়ে পিডিবিএফে চিঠি দিয়েছেন দুদকের সহকারী পরিচালক সুমিত্রা সেন। ইতোমধ্যে তাদের চাহিত নথিপত্র দুদকে পাঠানো হয়েছে বলে পিডিবিএফ সূত্র যুগান্তরকে নিশ্চিত করেছে।
তদন্ত প্রতিবেদন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য মঙ্গলবার সচিবালয়ের দপ্তরে বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। সচিব সাহেব কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত। উনি সুস্থ হয়ে অফিস শুরু করলে তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশের আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ইতোমধ্যে কিছুটা সুস্থ হয়ে অফিস শুরু করেছেন পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব মো. রেজাউল আহসান। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার কথা স্বীকার করে (৬ মার্চ) শনিবার মোবাইল ফোনে যুগান্তরকে বলেন, ‘পিডিবিএফের আগামী বোর্ড সভায় তদন্ত প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হবে। সেখানেই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত বছরের আগস্টে জনৈক জাহাঙ্গীর আলম পিডিবিএফের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে চাকরিবিধি লংঘন করে ব্যবসা করাসহ ৫টি বিষয়ে অভিযোগ করেন পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরে। অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে- ১. নিজস্ব ঠিকাদার কোম্পানির মাধ্যমে কাজ বাস্তবায়ন। ২. ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা গ্রহণ। ৩. অনৈতিক সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগ। ৪. আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ ও উচ্চপদে পদায়ন এবং ৫. ভুয়া বিল-ভাউচারে প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাৎ। এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দেন পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য।
মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব খালিদ পারভেজ খানকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর গঠিত ওই কমিটি দীর্ঘদিন তদন্ত করে সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তদন্ত কাজের মধ্যেই ভারপ্রাপ্ত এমডির পদ থেকে আমিনুল ইসলামকে সরিয়ে দিয়ে যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নতুন এমডি নিয়োগ দেওয়া হয়। এখনো তার (আমিনুল) বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এদিকে এসব অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছেন তিনি।
১নং অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, পিডিবিএফ প্রবিধান ও সরকারি কর্মচারী আইন অনুযায়ী, সরকারি কোনো কর্মচারী পূর্বানুমোদন ছাড়া অন্য কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন না। একই সঙ্গে স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কোনো কর্মকর্তা ব্যবসায়ও জড়াতে পারেন না।
কিন্তু বিধিবিধান অমান্য করে ক্রয় কমিটির প্রধানের দায়িত্বে থেকেও পিডিবিএফের ভারপ্রাপ্ত এমডি আমিনুল ইসলাম নির্বিঘ্নে বাণিজ্য করেছেন। ‘সৌরশক্তি উন্নয়ন কর্মসূচি’র ৮ কোটি টাকার কাজ সরাসরি ক্রয় প্রক্রিয়ায় ডকইয়ার্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের নামে ‘এনজিরা সোলার’ ও ‘সানার্জি টেকনোলজি লিমিটেড’র মাধ্যমে বাজার দরের দ্বিগুণ বেশি দামে উপকরণ কিনে বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
সানার্জি টেকনোলজির ১৫০০০ শেয়ারের মধ্যে ৫০০০ শেয়ারে মালিক ছিলেন পিডিবিএফের ভারপ্রাপ্ত এমডি আমিনুল ইসলাম। অভিযোগ ওঠার পর তা তিনি জনৈক জেসমিন আক্তার মৌসুমীর কাছে হস্তান্তর বা বিক্রি করে দেন। তার পরও ওই কোম্পানি বা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার (আমিনুল ইসলাম) ব্যবসায়িক সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়।’
প্রতিবেদনের ২নং অভিযোগে বলা হয়, আমিনুল ইসলাম বিভিন্ন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অনৈতিক আর্থিক সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়েছেন। এ বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত যাচাই করে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ২নং অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়।’
৪নং অভিযোগে বলা হয়, আমিনুল ইসলাম দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে ইতঃপূর্বে আর্থিক অনিয়মসহ বিভিন্ন অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত, অদক্ষ কর্মকর্তাদের অনৈতিক আর্থিক সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে সুবিধাজনক স্থানে উচ্চতর পদে পদায়ন করেছেন। এ বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সত্যতা রয়েছে মর্মে তদন্তকালে প্রতীয়মান হয়েছে।’ তবে তার বিরুদ্ধে ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ এবং চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগে আর্থিক লেনদেনের কোনো দালিলিক প্রমাণ পায়নি কমিটি।