দেশে ভুমিকম্প উৎপত্তিস্থলে তীব্রতায় ফেটে গেছে মাটি-সড়ক,নদীতে উঠেছিল বড় ডেউ। এ এক ভয়ংকর সময়। এমন ঝাঁকুনি আর দেখিনি। ঘরের দেয়াল কয়েক স্থানে ফেটে গেছে। বাইরে বের হতে গিয়ে স্বামী গুরুতর আহত হয়েছে। এখনও মনে হলে শরীর কাঁপে।’ এসব কথা বলেন নরসিংদীর পলাশ উপজেলার ওয়াপদা গেট এলাকার গৃহবধূ সামসুন নাহার মলি। গত ২১ নভেম্বর শুক্রবার সকালে আঘাত হানা ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল এই জেলা।
দেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূকম্পন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র জানিয়েছে, ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল নরসিংদীর মাধবদীতে।যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসজিএস বলছে, কেন্দ্রস্থল নরসিংদী সদর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার পশ্চিম-দক্ষিণ পশ্চিমে।
গুগল ম্যাপ অনুযায়ী, কেন্দ্রস্থল পলাশ উপজেলার ডাংগা গ্রাম। স্থানটি শীতলক্ষ্যা নদীর পারে। এটি পলাশ উপজেলার অধীন ঘোড়াশাল পৌর শহরের কাছাকাছি। মাধবদীও পলাশ উপজেলার পাশে।
সরেজমিন দেখা গেছে,ভূমিকম্পে পলাশ রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের প্রধান ফটকের সামনের রাস্তায় ফাটল দেখা দিয়েছে। কাছাকাছি একটি গরুর খামারের মাটি ফাঁকা হয়ে গেছে। অনেক ভবনে দেখা দিয়েছে ফাটল। হেলে পড়েছে বহুতল ভবন। ঘোড়াশাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে কিছু যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়েছে। আগুনও ধরেছিল। শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর পুরোনো রেলসেতুতে ফাটল দেখা দিয়েছে। দুজনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ২০ জন।
ডাংগা-কালীগঞ্জ খেয়াঘাটের মাঝি সুবাদ ভৌমিক জানান, ভূমিকম্পের সময় নদীর পানি অনেক ওপরে উঠে প্রচন্ড ঢেউ তুলেছিল। ভয় পেয়েছিলাম। অনেকক্ষণ পর বুঝতে পেরেছি, ভূমিকম্প হয়েছে। তবে আমার জীবনে এমন কম্পন এটাই প্রথম।
ডাংগা প্রাণ-আরএফএল কারখানার পাশে ইসলামপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নৈশপ্রহরী ফয়সাল বলেন, ‘আমরা প্রথমে বুঝতে পারিনি। মনে করেছিলাম, বাইরে কোনো ভারী লরি যাচ্ছে। পরে দেখি পাশের কারখানার সব ভবন কাঁপছে। শ্রমিকরা মুহূর্তে বাইরে বের হয়ে আসেন। তেমন ক্ষয়ক্ষতি না হলেও ভয়ে কয়েকজন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।’
পলাশ রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের পাশের দোকানদার ফজলু মিয়া বলেন, ভূমিকম্পের সময় হঠাৎ বিকট শব্দে মাটিসহ সব কাঁপতে থাকে। কিছুক্ষণ পরই কলেজের গেটের ভেতর মাটি সরে গিয়ে ফাটল দেখতে পাই। এমন ঘটনা আর কোনোদিন দেখিনি।
ওয়াপদা গেট-সংলগ্ন নূর নবী সানির স্ত্রী তামান্না বলেন বলে বোঝানো যাবে না, কেমন ছিল ওই সময়টা। বাচ্চাদের নিয়ে নিচে নামার সুযোগ পাইনি। শুধু আল্লাহকে ডেকেছি। এ সময় আমার ঘরে থাকা ফ্রিজ, টিভিসহ ঘরের আসবাব ভেঙে যায়।
শিশু আয়ান জানায়, সে খুব ভয় পেয়েছে। এখনও ভয় পাচ্ছে– যদি আবার এমন হয়!
ঘোড়াশাল মিয়াপাড়া গ্রামের প্লেশ্রেণিপড়ুয়া মুনতাসির আয়াত বলে, আমি ভয়ে কেঁদেছি। ঘরের ভেতর বই-খাতাসহ সবকিছু নিচে পড়ে গিয়েছিল। মা-বাবা আমাকে নিয়ে দৌড়ে বাইরে বের হয়েছিল।
ঘোড়াশাল বাজার ঘুরে দেখা গেছে, দোকানের তাকে রাখা মালপত্র নিচে পড়ে আছে। সবার চোখেমুখে আতঙ্ক। জুতা দোকানি আলম মিয়া বলেন, আমার দোকানে জুতাসহ বিভিন্ন ধরনের মালপত্র ছিল। ভূমিকম্প শুরু হলে সবকিছু পড়ে গিয়ে আসবাব ভেঙে গেছে।
এই বাজারের মুদি দোকানদার আসলাম মিয়া বলেন, কাচের মালপত্র সব ভেঙে গেছে। প্রথমে মনে হয়েছে, কেউ হামলা করেছে। পরক্ষণে বুঝতে পেরেছি, এটি হামলা নয়; ভূমিকম্প। বেশ ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়েছি।
বাজার ঈদগাহ সড়কে মারকাসুল সুন্নাহ তাহফিজুল কোরআন সুন্নাহ মাদ্রাসার পরিচালক মুফতি সালাউদ্দিন আনসারী বলেন, আমাদের ছয়তলা ভবনের চার-পাঁচ জায়গায় ফাটল দেখা দিয়েছে। শিক্ষার্থীরা ভয় পেয়েছে; আতঙ্কিত ছিল।
এ ভবনের মালিক আমানউল্লাহ বলেন,ভূমিকম্পে আমার ভবনে কয়েক জায়গায় ফাটল দেখা দিয়েছে। দোকানপাট বন্ধ। কেউ ভয়ে দোকান খুলছে না।
সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থদের একজন ঘোড়াশাল বাজারের ছয়তলা ভবনের এসএ প্লাজার নিচতলার মোবাইলের দোকানদার মোবারক হোসেন। তিনি বলেন, হঠাৎ সব কাঁপাকাঁপি শুরু করে। মনে হলো, সব ভেঙে পড়ছে। আমরা সবাই বাইরে বের হয়ে পড়ি। তিনি আরও বলেন, মার্কেটের ওপরতলা থেকে নারী-পুরুষ দৌড়াদৌড়ি করে নিচে নামার সময় অনেকে সিঁড়িতে পড়ে যান। কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা গেছে অনেককে।
বাজারের আল জিলানী মার্কেটের তিনতলার রেলিং ভেঙে পড়ে পাশের মুরগির খাদ্যের দোকানের ওপর। দোকানি তাজুল ইসলাম বলেন, ‘পুরো দেয়ালটা আমার দোকানের ওপর পড়ে। দোকানটা তছনছ হয়ে যায়। আমি কীভাবে বেঁচে গেলাম, এক আল্লাহ জানে। কাঁপুনি ও ঝাঁকুনি ছিল ভয়াবহ।’
আরটিভির জেলা প্রতিনিধি নূরে আলম রনি জানান, তিনি সকালে পলাশের বাসায় ছিলেন। হঠাৎ কাঁপুনি শুরু হলে দোতলা থেকে বাচ্চাকে নিয়ে বের হওয়ার সময় সিঁড়িতে পড়ে মুখে আঘাত পান। পরে তাঁকে স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
পলাশের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবু বক্কর সিদ্দিকী বলেন, ভূমিকম্পের পর বিদ্যুৎকেন্দ্র ও সার কারখানা পরিদর্শন করেছি। সরকারি খাদ্যগুদামের ভেতরে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। দ্রæত চাল স্থানান্তর করতে হবে। ভুক্তভোগীদের সহায়তার জন্য আমরা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খুলেছি। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের চেষ্টা করা হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্থদের সহায়তার জন্য ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। তথ্য ও ছবি-সংগৃহীত

ডেইলি খবরের সর্বশেষ নিউজ পেতে Google News অনুসরণ করুন।
আপনার মতামত লিখুন :