রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

বিত্তশালীর বিলাসী সন্তান ও সামাজিক বেত্রাঘাত/ ড. মো. ফখরুল ইসলাম

ডেইলি খবর ডেস্ক

প্রকাশিত: জুলাই ১, ২০২৪, ০৯:৩৫ এএম

বিত্তশালীর বিলাসী সন্তান ও সামাজিক বেত্রাঘাত/ ড. মো. ফখরুল ইসলাম

কুরবানি ঈদে ছাগলকান্ডে ভাইরাল এনবিআরের সাবেক সদস্য মতিউর রহমানের ছেলে মুশফিকুর রহমান ইফাত। গন্তানের জন্য বাবা-মায়ের স্নেহ-ভালোবাসার তুলনা হয় না। এ ভালোবাসা অকৃত্রিম, অফুরন্ত। তবে ‘জেলিফিস প্যারেন্টিং’ এই স্নেহ-ভালোবাসার খেই ধরে রাখতে অপারগ। বাবা-মায়ের আদর-যতœ, সোহাগ একদিকে যেমন সন্তানকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে, অন্যদিকে তেমনি কড়া নজরদারি ও শাসন সন্তানের ভবিষ্যৎ জীবন গড়ার পথকে সঠিকভাবে বাতলে দেয়। সুতরাং, এ বিষয়ে আমি কাউকে খাটো করে কিছু বলতে চাই না।
যেটা বলতে চাচ্ছি তা হলো, অবহেলা ও উদাসীনতার কারণে আলালের ঘরের দুলালরা আমাদের সমাজে কীভাবে নিগৃহীত ও হেয়প্রতিপন্ন হয় এবং তারা সামাজিকভাবে টিকে থাকার জন্য কতটুকু প্রস্তুত, সেই বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা দরকার। আবার বহুবিবাহ, যৌতুক, বাল্যবিয়ে, পারিবারিক বিশৃঙ্খলা ইত্যাদির ফলে শুধু অর্থবিত্তের প্রতাপে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবন কখনোই গড়ে ওঠে না, তার প্রমাণ রয়েছে ভূরিভূরি।
সম্প্রতি কুরবানির পশু ক্রয় করতে গিয়ে ঘটা পশুকান্ডে একজন বাবার রক্তের সম্পর্ক ভুলে নিজের সন্তানকে অস্বীকার করার ঘটনা জাতির বিবেককে ভিন্নভাবে নাড়া দিয়েছে। কুরবানির মহান শিক্ষা ও ত্যাগের আদর্শ ভুলে কিছু মানুষ যখন ক্রমাগত ভুল পথে নিজেকে জাহির করার জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে, তখন নিরীহ সর্বসাধারণের চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কী-ই বা করার থাকে! তবুও সামান্য এক অবলা পশুক্রয়ের কাহিনি আমাদের সমাজে অনেক সবলা পশুদের কুৎসিত চেহারাকে মুহূর্তেই কীভাবে টেনে বের করতে পারে, সেই অবস্থা দর্শনের গণমঞ্চ হঠাৎ তৈরি হয়ে গেছে। এর পেছনে আরও কোনো রহস্য লুকায়িত ছিল কিনা, তা ঘটনা পরম্পরায় এখনো ততটা স্পষ্ট নয়।
এ ইস্যু নিয়ে সামাজিক-রাজনৈতিক অঙ্গন, অফিসপাড়া, চায়ের দোকান, এমনকি বিমানবন্দর, স্থলবন্দরের শেডগুলোতে জনগণ এতটাই কৌতূহলী হয়ে উঠেছেন, তা যে কেউ একটু বাইরে বের হলে বুঝতে পারেন। মানুষের রক্তের সম্পর্ক কি এতই ঠুনকো? পুত্রের সঙ্গে পিতার রক্তের সম্পর্ককে অস্বীকার করার এত বড় হিম্মত কেন পাষাণ বাবার মনে এত সহজে জাগ্রত হয়-সেটা মানুষকে বড্ড অবাক করে তুলেছে। সবচেয়ে বেশি সম্মান পাচ্ছে ছাগল নামক নিরীহ প্রাণীটি।
মানুষ নামক প্রাণী গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকে অপরাধ করেছে আর একটি অবলা ছাগলের মাধ্যমে কীভাবে তা অনায়াসে, অকপটে মানবসমাজের গভীরে ছড়িয়ে পড়েছে, তা নিয়ে কবিতা, গান, ট্রল হতে দেরি হয়নি। ছাগল কালোটাকা চেনার সূত্র বের করে দিয়ে যে ইতিহাস গড়ে দিয়েছে, তা থেকে মানুষের অনেক শিক্ষণীয় আছে বলে অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। বেহিসাবি টাকা মানুষকে দেশপ্রেম থেকে বিচ্যুত করতে পারে, জন্মভূমির মায়া ত্যাগ করে পালিয়ে যেতে বাধ্য করতে পারে, সে কথা দেশের কর্ণধারের মুখ থেকে উচ্চারিত হতে দেখা গেছে। রাষ্ট্রীয় পদে থেকে ক্ষমতার অপব্যহার করার কারণে দিনে দিনে একশ্রেণির মানুষ অর্থবিত্তে বলীয়ান হয়ে চাঁদে বা মঙ্গলগ্রহে ওঠার স্বপ্ন দেখছে। আরেক শ্রেণির মানুষ দ্রব্যমূল্য সন্ত্রাসের শিকার হয়ে মৌলিক চাহিদা পূরণে সমাজে কারও কাছে ঠাঁই পাওয়ার সুযোগ না পেয়ে ধুঁকে ধুঁকে কালাতিপাত করে চলেছে-এটাই এখন আয়-বৈষম্যের চরম বাস্তবতা।
এত বিত্ত-বৈভব থাকার পরও আপন সন্তানকে অস্বীকার করার প্রকৃত সত্যটা আড়াল করার অপচেষ্টা স্পষ্ট হয়ে উঠতে না উঠতেই বাবার বিপক্ষে আরও বহু অজানা ঘটনা ও প্রশ্নের জন্ম হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে পশুক্রেতা খুবই ইনোসেন্ট। সামাজিক প্লাটফর্ম সদস্যদের মতামতের ওপর ভিত্তি করে বলা যায়-আদতে তার কোনো দোষ নেই। সেই পুত্র বেচারা একজন গোবেচারা বটে। সে বাবা-মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা জীবনযাপন করত। পারিবারিক স্নেহ-মমতা থেকে বঞ্চিত থাকতে থাকতে মাত্র ১৯ বছরে তার চেয়ে বয়সে বড় একজনকে বিয়ে করেছে বলে জানা গেছে। অঢেল টাকা দিয়ে তার জীবনকে সে ভিন্নভাবে সাজানোর চেষ্টা করেছে, যেখানে কোনো লুকোচুরি ছিল না। সে তার ‘নসিবকে’ ভরসা করে বেঁচে থাকার মূল্যবোধ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল।
গত কয়েক বছর ধরে সে তার ফেসবুকে দামি গাড়ি, জন্মদিন, আড্ডা, দামি পশু, পাখি নানা কিছুর ছবি পোস্ট দিয়ে নিকটজনদের কাছ থেকে বাহবা পেয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতায় এবারের ঈদে তার চাহিদা, শখ, বিলাসব্যসনের আকর্ষণ-প্রদর্শন আরও বেশি করে জাগ্রত হওয়ার পথে কোনোরূপ বাধা সে দেখতে পায়নি। অতি-আনন্দের আতিশয্যের বিপদ কী, সেটা সে কখনোই ভাবতে শেখেনি। এজন্য কোনো পারিবারিক ও সামাজিক শাসনও তার ওপর বর্তায়নি। ফলে এটাই হয়তো তার ব্যক্তিগত ও সামাজিক মূল্যবোধের বিচারে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক বিষয় হিসাবে প্রতীয়মান হয়েছে।
১৫ লাখ টাকায় আমাদের দেশে একটি খাসি কেনাবেচা হয় না, সেটা তার ধারণার মধ্যে ছিল না। আমাদের ভোগ্যপণ্যের বাজারে মূল্য নিরূপণের কোনো বিধিনিষেধ না থাকায় পশুফার্মের মালিকরা যা খুশি তাই দাম হাঁকাতে পারেন। তারা মানুষকে বিভ্রান্ত করে তুলতে পারেন। এতে ক্রেতাদের কার কী বা আসে-যায়!
আজকাল আমাদের সমাজে কোনো কিছুর ওপর সুষ্ঠু সামাজিক নিয়ন্ত্রণ আশা করা কঠিন। মৌলিক নিত্যপণ্যের বাজারে এ নিয়ন্ত্রণ আরও বেশি অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এটাও বা এবারের কুরবানির পশুকান্ড সৃষ্টির পেছনে কম দায়ী হবে কেন!
তবে একটি পশুকান্ড থেকে এভাবে থলের সব বিড়াল বের হয়ে পড়বে এবং একজন আপন সন্তানকে নিজের বলে অস্বীকার করার ঘটনা এভাবে চাউর হয়ে সর্বত্র সামাজিক ঘৃণা ছড়িয়ে পড়বে, সেটা ক্ষমতাধর বাবাও আঁচ করতে পারেননি। এটাকেই বলে-‘পাপ তার বাপকেও ছাড়ে না’। ভাগ্যিস ফেনীর একজন সংসদ-সদস্য তার আত্মীয়তার সম্পর্কের কথা বলে অতিদ্রæত বাবা-ছেলের সম্পর্কের সত্য কথা প্রকাশ করে দিয়েছিলেন। তা-না হলে হয়তো সেটা আরও কোনো অস্বীকারের বেড়াজালে পড়ে যেতে পারত! এটি ‘পাইপিং হট টি’ বা গরম গরম চায়ের মতো সামাজিক নেটওয়ার্কে ওত পেতে থাকা তার গ্রæপের কৌতূহলীরা লুফে নিতে দেরি করেননি।
আর্থিক লুটতরাজের কৃষ্টি কুরবানির পশু কেনার মাধ্যমে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা গত প্রায় এক যুগ থেকে দেখা যাচ্ছিল। গত ক’বছর ধরে দৈত্যাকার পশুপালন ও ক্রয়-বিক্রয় অনেকটাই কমে গেছে। পশু মোটাতাজাকরণ প্রকল্পের মালিক ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা এজন্য নিরুৎসাহিত হয়ে পথে বসেছেন। অবৈধ টাকার মালিক ক্ষমতাধর ক্রেতারা প্রকাশ্যে পশুহাটে এর ক্রয় থেকে বিরত হওয়া শুরু করেছেন। তাদের অনেকেই আজকাল ইন্টারনেটে পশুর ছবি দেখে বা অ্যাগ্রো ফার্মে গিয়ে তথ্য লুকিয়ে কেনাবেচা করেন। এত সতর্কতার পরও এক ছাগল অনেককে পাগল করে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করেছে। ফলে বড় বড় পশু বিক্রি করতে না পেরে অনেক বিক্রেতা হাটে বসে কান্নাকাটিও করেছেন।
পশুকান্ডের শিকার ছাগলটি ঈদের এক সপ্তাহ পরও বায়নাকারী নিতে আসেনি। তিনি বায়নার টাকাও ফেরত নিতে আসছেন না। অ্যাগ্রো ফার্মের মালিকের এতে বিপত্তি শুরু হয়েছে। এখন সব দোষ ছেলেটির বলা হলেও সব কাহিনি ছেলেটির নয়। কাহিনি শুরু হয়েছে অন্য জায়গায়। তার সৎভাইবোনরা ক্ষিপ্ত। পরিবারের অনেকের বিদেশ যাওয়া বন্ধ।
আমাদের দেশে মানুষের স্বপ্নের সঙ্গে মূল্যবোধ লালনের বৈপরীত্য চলছে। চলমান দুর্নীতিকে অ্যাড্রেস করতে গিয়ে অনেক রথী-মহারথী মিথ্যা ও জালিয়াতির আশ্রয় নিতে কার্পণ্য করছেন না। এজন্য তারা বাবা-মা, নিকটাত্মীয়দের দূরে ঠেলে দিয়েছেন। নিজের সন্তানকে নিজের নয় বলে অস্বীকার করতে কাঁপছেন না। সামান্য সরকারি চাকরি করার সুবাদে হঠাৎ ফুলে-ফেঁপে ওঠা এসব সন্দেহজনক বিত্তশালী ও তাদের বিলাসী পোষ্যদের বিরুদ্ধে তাই চারদিকে শুরু হয়েছে গুঞ্জন। দিকে দিকে সামাজিক প্রচারমাধ্যমে তাদের ঘৃণা করা হচ্ছে। দাবি উঠেছে, তাদের প্রদর্শিত পরি-সামাজিক অবক্ষয় রোধ করার। কারণ, তারা বরেরও মাসি, কনেরও পিসি। প্রচলিত আইন ও বিচারের তোয়াক্কা বা ভয় করে না তারা। তাই সময় হয়েছে তাদের সামাজিক বেত্রাঘাত (সোশ্যাল হুইপল্যাস) দেওয়ার। পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা সচেতন মানুষ নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে এ কাজটি শুরু করেছেন। যার উদ্দেশ্য হচ্ছে, দুর্নীতিমুক্ত একটি সহনশীল ও বৈষম্যহীন, ন্যায়ানুগ সমাজব্যবস্থা সৃষ্টি করা। এ কাজে গণমাধ্যমের সহনশীল ভূমিকা অতি বেশি। এ ছাড়া আমাদের বঞ্চিত প্রজন্মের মুক্তি মিলবে কীভাবে?
ড. মো. ফখরুল ইসলাম : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন
ভধশৎঁষ@ৎঁ.ধপ.নফ

 

 

ডেইলি খবর টুয়েন্টিফোর

Link copied!