মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২৫, ২ বৈশাখ ১৪৩২

হাজার বছরের সংস্কৃতি সীমায় আবদ্ধ করা যাবে না/আবুল কাসেম ফজলুল হক

ডেইলি খবর ডেস্ক

প্রকাশিত: এপ্রিল ১৪, ২০২৫, ০৩:২৭ পিএম

হাজার বছরের সংস্কৃতি সীমায় আবদ্ধ করা যাবে না/আবুল কাসেম ফজলুল হক

পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ কিংবা আদর্শবাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিবাদ, যে প্রতিবাদ আমাদের এগিয়ে দিয়েছিল, সেই উদ্যোগ ও উদ্যমকে পরবর্তী সময়ে বিকৃত করে ফেলা হয়। এই বিকৃতকরণের ফলে জনগণের একটি অংশে এমন ধারণা জন্মে, এই নববর্ষ উদযাপন এক ধরনের ‘হিন্দুয়ানি’, মুসলমানদের এভাবে উৎসব করা উচিত নয় অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বাংলাদেশের সর্বাগ্রগণ্য বুদ্ধিজীবীদের একজন, একই সঙ্গে শ্রেষ্ঠ মননশীল সাহিত্যিকদের অন্যতম। সম্প্রতি নববর্ষ উপলক্ষে এক বিশেষ আলাপে সমকালকে সময় দিয়েছেন।
প্রতিবছর বৈশাখ এলে কিছু মানুষের মধ্যে নববর্ষ উদযাপনের প্রতি এক ধরনের বিরূপ মনোভাব চোখে পড়ে। পক্ষে-বিপক্ষে তর্কবিতর্ক হতে দেখা যায়। এমন একটি সর্বজনীন উৎসবের প্রশ্নে কখন আমরা এমন বিভাজিত হয়ে গেলাম বলে আপনি মনে করেন?
আবুল কাসেম ফজলুল হক উওওে বলেন পাকিস্তান সরকার পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ তৈরির জন্য কিছু কর্মনীতি নিয়ে সংস্থাভিত্তিক কাজ করেছিল। ব্যুরো অব ন্যাশনাল রিকনস্ট্রাকশন, পাকিস্তান কাউন্সিল ফর ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেশন প্রভৃতি গঠিত হয়েছিল এবং বাংলা একাডেমিকেও একই কাজে ব্যবহারের চেষ্টা করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল, একটি পাকিস্তানি সংস্কৃতি নির্মাণ। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান, বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতি সবকিছুর একটি সমন্বয় ঘটিয়ে পাকিস্তানি আদর্শবাদের বিকাশ ঘটানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। আমরা এর প্রতিবাদ করেছি। যারা লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী ছিলেন, তারা সেই প্রতিবাদের সামনের সারিতে ছিলেন। ফলে এই প্রচেষ্টা যখন থেকে শুরু হয়েছিল,এর বিরুদ্ধে আন্দোলনও তখন থেকেই শুরু হয়। আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ভূমিকা ছিল অগ্রণী। সেই ছাত্ররাই পরবর্তী সময়ে দেশ শাসন করেছেন। তাদের হাতেই মূলত বিগত ৫০ বছরের রাজনীতি পরিচালিত হয়েছে। সেই যে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ কিংবা আদর্শবাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিবাদ, যে প্রতিবাদ আমাদের এগিয়ে দিয়েছিল, সেই উদ্যোগ ও উদ্যমকে পরবর্তী সময়ে বিকৃত করে ফেলা হয়, আমি মনে করি। এই বিকৃতকরণের ফলে জনগণের একটি অংশে এমন ধারণা জন্মে, এই নববর্ষ উদযাপন এক ধরনের ‘হিন্দুয়ানি’, মুসলমানদের এভাবে উৎসব করা উচিত নয়। সেই ধারণা-পরবর্তীকালে আমাদের জাতীয় কর্মকান্ডে ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার চক্র তৈরি করে। 
ঠিক কীভাবে এই বিকৃতকরণ ঘটেছে? এটি তো সর্বজনীন বর্ষবরণ উৎসব ছিল। রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ বা শোভাযাত্রা তো নয় এর উওওে আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন বেগম সুফিয়া কামালকে শেখ মুজিব শ্রদ্ধা করতেন। সুফিয়া কামাল কোনো কথা বললে মুজিব তাঁকে মর্যাদার সঙ্গে গ্রাহ্য করতেন। আওয়ামী লীগ পরবর্তী সময়ে সুফিয়া কামালের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনে সেই ধারা বজায় রেখেছে। তবে তাঁকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের বুদ্ধিজীবীরা যেভাবে বেশ কয়েক বছর অনুষ্ঠানাদি করেছেন, সার্বিক বাস্তবতা বিচারে আমার কাছে পরিপক্ব, গ্রহণযোগ্য মনে হতো না। শওকত ওসমান, কবীর চৌধুরীসহ আরও অনেকে যখন নববর্ষের মিছিলে আসতেন, কিছুটা অদ্ভুত ধরনের পোশাক পরে আসতেন। সাধারণ পোশাক থাকত, তবে হয়তো অদ্ভুত ধরনের একটা টুপি অথবা গলায় একটা স্কার্ফও থাকত। আমার মনে হয়েছে, এক ধরনের দেখানোপনা ছিল তাতে। বর্ষবরণের মিছিলে তারা সামনেই থাকতেন। এবং দেখলেই মনে হতো, তারা বোধ হয় প্রহসন করছেন। মানুষের মনে এর প্রভাব পড়ত। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সনাতনী, বৈষ্ণবী ধারার সংগীত পরিবেশিত হয়েছে। তা হতে পারে। কিন্তু অপরাপর ধর্মীয় অনুষঙ্গের সঙ্গে একটা সচেতন সাম্য রক্ষা করা হয়নি। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মুসলমানদের কেউ কেউ বিচ্ছিন্ন বোধ করেছে। আরেকটি বিষয় দাঁড়ায়। গোলাম আযমের প্রতিকৃতিতে ঢিল ছুড়ে মারার বিষয়টি সামনে আসে। বেগম সুফিয়া কামালের হাতে প্রথম ঢিল তুলে দেওয়া হয়েছিল। প্রথম পাথরটা তিনি গোলাম আযমের খড়ের পুতুলে ছুড়ে মারলেন,ওটাকে গোলাম আযমের প্রতিকৃতি বলার চেয়ে যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধী অপরাধীদের প্রতীকী কুশপুতুল বলাই কি যথার্থ নয়?
আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন হ্যাঁ,মানবতাবিরোধীদের কুশপুতুল। তা হলেও স্থান-কাল-পাত্র বিচার করলে প্রশ্ন জন্মায়। এসব কাজ যত বেশি করেছে সরকার,পরিস্থিতি তত ভারসাম্য হারিয়েছে। ধর্মগুলো টিকে যাওয়ার একটি কারণ হচ্ছে, নৈতিকতার প্রশ্নে ধর্ম স্পষ্ট অবস্থান ব্যক্ত করে। ধর্মকে ভিত্তি ধরে যারা রাজনীতি করতে চেয়েছে, তারা এ সমস্তকে পুঁজি করতে পেরেছে। বিরোধী তথাকথিত ‘ইসলামী ধারার’ দিকে অনেক মানুষ ধাবিত হয়েছে। সবাই তো জামায়াতে ইসলামীতে গেছে, তা নয়। জামায়াত ছাড়া আরও কিছু দল ছিল। আজও ওদের দেখতে পাই। আরও নানান রূপ পেয়েছে। ওই ইসলামী দলগুলো এখনও এককভাবে জয়লাভ করতে পারবে না। তারা বড় দুই দলের যার সঙ্গেই যাবে, তাদেরই বিজয়ে বড় ভূমিকা রাখবে। আরও একটি বিষয়। পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিগুলোর অনেক দিনের পরিকল্পনা, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে একটা বড় রাজনৈতিক শক্তির জন্ম দেবে। ওই পাশ্চাত্য শক্তি যেমনটা চায়,আওয়ামী লীগ বা বিএনপির মাধ্যমে তেমনটা করতে পারবে না। এখন তাদের উদ্দেশ্য সাধনে যা প্রয়োজন, তা তারা করবে দেশের সাংস্কৃতিক তৎপরতাকেও তা প্রভাবিত করবে। এমন মুহূর্তে কী করতে পারি আমরা? এমন প্রশ্নের উওওে আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন জাতীয় ঐক্য গঠনের উদ্দেশ্যে একটি ধারা বা চিন্তাকে আমরা পরিবর্তন করতে চাইছি। আমাদের কাজে এর প্রতিফলন থাকা চাই। 
আপনার কথার পরিপ্রেক্ষিতে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। শেখ হাসিনারও একটা রাক্ষুসে মূর্তি তৈরি করা হয়েছে। আপনি কি এ বিষয়ে জেনেছেন? মনে হচ্ছে কি অপরাজনীতির একই চক্র ঘুরছে? গোলাম আযমের কুশপুতুলের সঙ্গে এটা কতখানি তুলনীয়।
আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন আমি ওটার কথা শুনেছি। হ্যাঁ, ওটার সঙ্গে মিল আছে। ঢিলটা ছোড়া হয়েছিল এভাবে চিহ্নিত করে, এরা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। এরা রাষ্ট্রটিকে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ করতে চায়নি। এবং সেভাবেই কাজ করেছে। অতএব, তাদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে পাথর ছুড়েছে। এখানে শেখ হাসিনার তেমন মূর্তি তৈরি হলে বলতে হবে, একই পন্থায় শত্রু চিহ্নিত করা হচ্ছে। বলা হবে, এরা স্বৈরাচারী, এই স্বৈরাচারকে আর উঠতে দেব না। একটা ঐতিহাসিক নিরাসক্তি (হিস্টরিক্যাল ডিটাচমেন্ট) নিয়ে কেউ পরিস্থিতি বিবেচনা করেনি। এই স্তরে আমাদের উন্নীত হতে হবে।এ ধারা চলতে থাকলে আমরা কি কোনো পুনরাবৃত্তির চক্র থেকে বের হতে পারব? তাহলে কি জাতীয় ঐক্য বা বহুধারার রাজনীতির সামষ্টিক লব্ধি সেই একই থেকে যাবে সামনেও?
আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন আমি তাই মনে করছি। এভাবে চললে পুনরাবৃত্তি ঘটবে। এর আগেও জরুরি অবস্থা এসেছে দেশে। আমরা শুনেছি, এবার পরিবর্তন হবে। কিন্তু যখনই নির্বাচন এসেছে, পরিবর্তিত ধারায় কেউ কিছুই করতে পারেননি। আগের ধারাই বজায় ছিল এবং রাজনৈতিক অবস্থারও কোনো উন্নতি হয়নি। শেখ সাহেব ক্ষমতায় থাকাকালে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন রাজনৈতিক পরিস্থিতি একটু শান্ত করার জন্য। কিন্তু জরুরি অবস্থার পর দেখা গেছে, পরিস্থিতি আগের চেয়ে দ্রæত খারাপের দিকে গেছে। এবং এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলেন। বঙ্গবন্ধু যে নিহত হলেন, তা কেবল বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের জন্য নয়, আওয়ামী লীগের জন্য নয়– গোটা জাতির জন্য ক্ষতির কারণ হয়েছে। নানান কারণে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব সফল হয়নি। যদি সেসব কারণ না সৃষ্টি হতো, তাঁর নেতৃত্ব যদি মোটামুটি সফলও হতো, আমরা আরও ভালো অবস্থানে থাকতাম। এখন পর্যন্ত শেখ হাসিনা যেভাবে কথা বলছেন, তা বঙ্গবন্ধু যেসব কথা বলার ফলে প্রাণ হারিয়েছিলেন, তারই পুনরাবৃত্তি। বঙ্গবন্ধু একটু দ্রæত কথা বলতেন, হাসিনা একটু ধীরে বলেন। কিন্তু একই কথা। যার ফলে তাঁকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হলো। এখন যদি আমরা ভাবি, আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়েছে, আমরা খুশি; ভাবনাটা ভুল হবে। তাদের পরাজয় অনেক নির্যাতিতের উপকারে এসেছে। কিন্তু তাঁকে দেশত্যাগের মাধ্যমে বাঁচতে হলো, এটা গোটা জাতির জন্য ভীতিকর। 
এমন সমাজে দাঁড়িয়ে আমাদের বর্ষবরণের উদ্যোগকে যদি আমরা আরও ব্যাপকতা দিতে চাই,বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নববর্ষের আয়োজন নিয়ে গর্ব করার মতো নতুন, বৈশ্বিক উপস্থাপন যদি উপহার দিতে চাই, কী করা যেতে পারে?
আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন একটি কথা আমার মনে জাগে। ঢাকায় বর্ষবরণের বৃহত্তর মূল আয়োজনের কেন্দ্রে থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ। চারুকলার শিক্ষকদের প্রতি আমার পূর্ণ শ্রদ্ধা রয়েছে। চারুকলার শিক্ষার্থীদের প্রতিও আমার পূর্ণ মমতা ও আগ্রহ রয়েছে, থাকবে। কিন্তু মানুষমাত্রই তো ভুল করতে পারে। আমার মনে হয়, সে ধরনের ভুল কিছু কাজ করা হয়েছে। বেগম সুফিয়া কামালকে সামনে রেখে বিভেদ সৃষ্টিকারী কিছু ভুল কাজ করা হয়েছিল। সেগুলোর প্রতিক্রিয়া আমরা পরবর্তী সময়ে দেখতে পেয়েছি। পুরোনো পত্রপত্রিকায় দেখতে পাওয়া যাবে। আরও অনেকেই ছিলেন। আমি নাম বলতে চাই না। বিভেদ বাড়াতে চাই না। ভবিষ্যতে বিভেদ নিরসনের স্বার্থে কথাগুলো বলছি। আমার মনে হয়, এখানে আরও চিন্তা যুক্ত করা প্রয়োজন। বর্ষবরণের উদ্যোগ চারুকলায় অবশ্যই থাকবে। তবে চারুকলাসহ অপরাপর আরও অনুষদকে সম্পৃক্ত করে একটি নতুন কেন্দ্র তৈরি করা যেতে পারে। আরও নানান অনুষদ যুক্ত হলে চিন্তা একটা সম্পূর্ণতা পাবে। বর্ষবরণের অনুষ্ঠানটি বিকাশমান থাকবে। আমাদের সংস্কৃতিকে বিকাশমান হতে হবে। সীমায় আবদ্ধ করা যাবে না। আমাদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যবিষয়ক আলোচনা গণমাধ্যমগুলোয় আরও বাড়াতে হবে। বলা হয়, হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি। দেড় হাজার বছরের প্রমাণাদি মেলে। মূলত এটি হাজার বছর নয়, আরও পুরাতন। 
মঙ্গল শোভাযাত্রা নামটি বাদ দেওয়া হলো। নতুন নাম হলো বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য শুনতে চাই। মঙ্গল শব্দটি কি যথেষ্ট ব্যাপক ছিল না? আবুল কাসেম ফজলুল হক  বলেন মঙ্গল শোভাযাত্রা অত্যন্ত অর্থপূর্ণ ও সবার জন্য গ্রহণযোগ্য শব্দ, বিশেষ করে এই নববর্ষ উপলক্ষে। এ সিদ্ধান্তে প্রধান উপদেষ্টার অভিমতও নেওয়া হয়েছে নিশ্চয়ই। পরিবর্তনের পেছনের কারণ কী হতে পারে? মঙ্গল শোভাযাত্রা শব্দটি সনাতন ধর্মের কিছু কিছু অনুষ্ঠানেও ব্যবহৃত হয়। হয়তো এটি বিবেচনার চেষ্টা থেকে,প্রত্যেককে অন্তর্ভুক্ত করার চিন্তায় মঙ্গল শোভাযাত্রা শব্দ বাদ দিয়ে আনন্দ শোভাযাত্রা করা হয়েছে। বলা যায়, এটি এক ধরনের আপসে নিষ্পত্তি করার চেষ্টা। সৌজন্য-সমকাল

 

ডেইলি খবর টুয়েন্টিফোর

Link copied!