বুধবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৫, ২ বৈশাখ ১৪৩২

ইসরাইলি হামলা আবারও হাসপাতালে রোগীদের গা শিউরে ওঠার বর্ণনা

বিশ্ব ডেস্ক

প্রকাশিত: এপ্রিল ১৪, ২০২৫, ০৩:০২ পিএম

ইসরাইলি হামলা আবারও হাসপাতালে রোগীদের গা শিউরে ওঠার বর্ণনা

ফিলিস্তিনির গাজার আল-আহলি আরব হাসপাতালের একটি তাঁবু ওয়ার্ডে ইউসুফ আবু সাকরান তার আহত সন্তান এবং স্ত্রী ইমানের পাশে ঘুমাচ্ছিলেন। ঠিক তখনই লোকজনের দৌড়াদৌড়ি এবং চিৎকারের শব্দ। ঘুম ভেঙে যায় তার। রোববার ভোর হওয়ার অনেক আগেই তিনি হাসপাতালের প্রাঙ্গণে পা রেখে জিজ্ঞাসা করলেন-কী হচ্ছে? কিন্তু কোনও স্পষ্ট উত্তর তিনি পাননি। কেবল অস্পষ্ট খবর ছিল যে-ইসরাইলি সেনাবাহিনী হাসপাতালের আশপাশে বসবাসকারী লোকদের কাছে ফোন করে চিকিৎসা কেন্দ্রের সকলকে সরে যেতে বলেছে। ২৯ বছর বয়সী পিতা সাকরান তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিক্রিয়া জানালেন। তিনি তার পাঁচ বছর বয়সী ছেলে মোহাম্মদকে কোলে তুলে নিলেন। তিনি এবং তার স্ত্রী ইমান গেটের দিকে দৌড়ে গেলেন। ইউসুফের ছেলে মোহাম্মদকে নিয়ে সামিল হয়েছেন তিনি। তার ছেলে মোহাম্মদের সারা শরীরে গুরুতর আঘাত। তার পিঠ এবং পায়ে তৃতীয়-ডিগ্রি পোড়া। ইউসুফকে তাকে কোলে নিয়ে দৌড়াতে হচ্ছে। তিনি বলেন, আমার ছেলেকে কোলে নিয়ে দৌড়াচ্ছিলাম। তার শরীর পুড়ে গেছে। সে প্রচন্ড চিৎকার করছিল। তার পিঠ থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। তার ক্ষত থেকে প্রচন্ড রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। সে যন্ত্রণায় চিৎকার করছিল। আকস্মিক এভাবে দৌড়াদৌড়িতে অনেক মানুষের ক্ষত আবার কাঁচা হয়ে উঠল। আমি মেরুদন্ডের আঘাতে আক্রান্ত একটি মেয়ের পরিবারকে তার বিছানা টেনে তোলার চেষ্টা করতে দেখলাম। কিন্তু বিছানাটি ধ্বংসস্তুপের মধ্যে আটকে ছিল। আমরা হাসপাতাল  থেকে বের হওয়ার কয়েক সেকেন্ড পরেই দুটি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে। তা পুরো জায়গাটিকে কাঁপিয়ে তোলে। আমার স্ত্রীকে বললাম-ভাবো, আমরা যদি এক মিনিট পরে বের হতাম তাহলে আমরা মারা যেতাম।
আহত ছেলেকে নিয়ে কোথায় যাব?ইউসুফ এবং তার স্ত্রী হাসপাতালের অন্য সকলের সঙ্গে রাস্তায় অবস্থান নিয়েছেন। রোববার রাতে তিনি বলেন, রাত প্রায় ২টা বাজে। আমার আহত ছেলেকে কোথায় নিয়ে যাব বুঝতে পারছি না। ছেলে ব্যথায় কাতরাচ্ছে। তার রক্তক্ষরণ হচ্ছে। কোনও ক্লিনিক বা হাসপাতাল নেই। আমরা যে তাঁবুতে থাকি তা অনেক দূরে। ছেলের এই ক্ষতের চিকিৎসা দেয়ার জন্য সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত সেটা।
উল্লেখ্য, গাজার শুজাইয়া পাড়ায় ইসরাইলি বিমান হামলায় ইউসুফের ছেলে মোহাম্মদ আহত হন। সেখানে ২০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত এবং কয়েক ডজন আহত হয়েছেন। হাসপাতালটিতে বোমা হামলার এক ঘন্টা পর ইউসুফ এবং তার স্ত্রী সিদ্ধান্ত নেন যে-মোহাম্মদকে আল-আহলিতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া তাদের করার কিছুই নেই। ইউসুফ বলেন, জায়গাটা ছিল ঘন কালো। বারুদ আর ধুলোর গন্ধ বের হচ্ছিল। আমি হাসপাতালের শেষ প্রান্তে অবস্থিত সার্জারি ভবনে গিয়েছি একজন নার্সকে পেয়েছিলাম। তিনি মোহাম্মদের অবস্থার দেখে করুণা দেখান। তার ক্ষতের চিকিৎসা করেন। তাকে ভর্তি করে নেন। ইউসুফ আরও বলেন,এভাবে একটি হাসপাতালে বোমা হামলা মানবতার বিবেকের উপর কলঙ্ক। তারা আমাদের মাথার উপর দিয়ে বাড়িঘরে বোমা মারছে। তারপর রোগী এবং আহতদের ভেতরে থাকা অবস্থায় হাসপাতালগুলিতে বোমা মারছে। আমরা কোথায় যাব?
বিপদ থেকে নিজেকে বের করে আনা-২০ বছর বয়সী সুহাইব হামেদ ওই হাসপাতালের জরুরি ভবনের ঠিক পাশেই আরেকটি তাঁবু ওয়ার্ডে ঘুমাচ্ছিলেন। সেখানেও জায়নবাদীরা আঘাত হানে। ২৯শে ফেব্রæয়ারি ২০২৪ তারিখে হামেদ তার ক্ষুধার্ত পরিবারের জন্য আটা আনতে গিয়ে আহত হন। এই দিনটি ‘ময়দা গণহত্যা’ নামে পরিচিত। এদিন খাদ্য সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করার সময় ইসরাইল ১০৯ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে এবং কয়েক ডজনকে আহত করে। ইসরাইলি ট্যাঙ্ক থেকে ছোড়া গুলি তার পায়ে বিদ্ধ হয়। ফলে তার হাড় এবং টিস্যু এতটাই ক্ষতিগ্রস্থ হয় যে, তাতে ধাতব দন্ডের প্রতিস্থাপন করার প্রয়োজন হয়। তখন থেকেই তিনি অর্থোপেডিক বিভাগে চিকিৎসাধীন। সুহাইব তার পায়ের ক্ষত পরিষ্কার করার পর সার্জারি বিভাগ থেকে বেরিয়ে আসার সময় আল জাজিরাকে বলেন, আমার ভাই, যে সাধারণত আমার সাথেই থাকে, ইসরাইলের গুলির সময় সেখানে ছিল না। আমি জানি না কীভাবে আমি আমার আহত পায়ের উপর দাঁড়িয়ে, ক্রাচ ধরে পালিয়ে যেতে পেরেছি। চারপাশে যা দেখলাম তাতে আমার যন্ত্রণা ভুলে গেলাম। সবাই আতঙ্কে আর ভয়ে চিৎকার করছিল। শুধু বেঁচে থাকার চেষ্টা করছিল। 
দুটি ইসরাইলি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানার কয়েক মিনিট আগে সুহাইব হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন। তিনি বলেন, আমার পা আর সহ্য করতে পারছিল না। আমার ক্ষত আবার কাঁচা হয়ে গেল। আবার রক্তপাত শুরু হল। ফলে তিনি আর হাঁটতে পারছিলেন না। তাই তিনি থামলেন। তার ভাইকে ডাকলেন। তার ভাই এসে তাকে জেইতুন পাড়ায় তাদের বাড়িতে নিয়ে গেলেন।
পায়ের ব্যথা সুহাইবকে জাগিয়ে তুলছিল। তিনি বলেন, আমার অবস্থার কারণে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে হাসপাতালে আছি। সুহাইবকে চিকিৎসার জন্য গাজার বাইরে ভ্রমণের জন্য রেফার করা হয়েছে। কিন্তু এক বছর ধরে তিনি দেশের বাইরে যাওয়ার অপেক্ষায় আছেন। বলেন, আমাদের ভ্রমণ বন্ধ করে দেওয়া এবং নিষেধাজ্ঞা কি যথেষ্ট নয়? এমনকি ইসরাইল সেই হাসপাতালকেও টার্গেট করে, যেখানে এখনও যা আছে তা দিয়ে আমাদের চিকিৎসা করা হচ্ছে।বিপর্যয়কর পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তোলা-আল-আহলির উপর ইসরাইলি হামলা গাজার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার জন্য ইতিমধ্যেই বিপর্যয়কর পরিস্থিতিকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। ইসরাইলি বোমাবর্ষণ এবং ওষুধ, চিকিৎসা সরবরাহ এবং জ্বালানির উপর অবরোধ অব্যাহত থাকায় সেখানে চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। আল-আহলির পরিচালক ফাদেল নাঈম আল জাজিরাকে বলেন, ইসরাইল হাসপাতাল কর্মীদের রোগীদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য ন্যূনতম সময়ও দেয়নি। এ কারণে যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে, তাতে অক্সিজেনের অভাবে একটি শিশু মারা গেছে। ডাক্তার আরও বলেন, ইসরাইল গুরুত্বপূর্ণ জরুরি বিভাগ, রেডিওলজি, ল্যাবরেটরি এবং কেন্দ্রীয় ফার্মেসি বিভাগ ধ্বংস করেছে। আমাদের কার্যক্রম পুনরায় শুরু করতে সপ্তাহ বা মাস লেগে যাবে। এই হাসপাতালটি পরিষেবার একটি কেন্দ্র এবং এখানে সমস্ত প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। এর মধ্যে গাজার একমাত্র সিটি স্ক্যান মেশিনও রয়েছে। রোগী এবং আহতদের ভাগ্য এখন অজানা। আমাদের এগুলি অন্য হাসপাতালে পাঠাতে হবে। কিন্তু কোনও হাসপাতালই পূর্ণাঙ্গ পরিষেবা দেয়ার জন্য প্রস্তুত নয়।ছবি-সংগৃহীত

 

ডেইলি খবর টুয়েন্টিফোর

Link copied!